হইয়া গেছে। কিন্তু, ছি ছি, সেনাপতি, তাই বলিয়া কি সন্ধ্যার অন্ধকারে চোরের মতো রাজান্তঃপুরের উদ্যানপ্রাচীর লঙ্ঘন করিতে হয়। তুমিই না ভুবনবিজয়ী বীরপুরুষ!
কিন্তু, যে উপন্যাস লেখে তাহার কোথাও বাধা নাই; দ্বারীরা দ্বাররোধ করে না, অসূর্যম্পশ্যরূপা রমণীরাও আপত্তি প্রকাশ করে না, অতএব এই সুরম্য বসন্তসন্ধ্যায় দক্ষিণবায়ুবীজিত রাজান্তঃপুরের নিভৃত উদ্যানে একবার প্রবেশ করা যাক। হে পাঠিকা, তোমরাও আইস, এবং পাঠকগণ, ইচ্ছা করিলে তোমরাও অনুবর্তী হইতে পার আমি অভয়দান করিতেছি।
একবার চাহিয়া দেখে, বকুলতলের তৃণশয্যায় সন্ধ্যাতারার প্রতিমার মতো ওই রমণী কে। হে পাঠক, হে পাঠিকা, তোমরা উহাকে জান কি। অমন রূপ কোথাও দেখিয়াছ? রূপের কি কখনো বর্ণনা করা যায়। ভাষা কি কখনো কোনো মন্ত্রবলে এমন জীবন যৌবন এবং লাবণ্যে ভরিয়া উঠিতে পারে। হে পাঠক, তোমার যদি দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ হয় তবে স্ত্রীর মুখ স্মরণ করো। হে রূপসী পাঠিকা, যে যুবতীকে দেখিয়া তুমি সঙ্গিনীকে বলিয়াছ ইহাকে কী এমন ভালো দেখিতে, ভাই। হউক সুন্দরী, কিন্তু ভাই, তেমন শ্রী নাই’— তাহার মুখ মনে করে, ওই তরুতলবর্তিনী রাজকুমারীর সহিত তাহার কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য উপলব্ধি করিবে। পাঠক এবং পাঠিকা, এবার চিনিলে কি। উনিই রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা।
রাজকুমারী কোলের উপর ফুল রাখিয়া নতমুখে মালা গাঁথিতেছেন, সহচরী কেহই নাই। গাঁথিতে গাঁথিতে এক-একবার অঙ্গুলি আপনার সুকুমার কার্যে শৈথিল্য করিতেছে; উদাসীন দৃষ্টি কোন-এক অতিদূরবর্তী চিন্তারাজ্যে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছে। রাজকুমারী কী ভাবিতেছেন।
কিন্তু, হে পাঠক, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না। কুমারীর নিভৃত হৃদয়মন্দিরের মধ্যে আজি এই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় কোন্ মর্তদেবতার আরতি হইতেছে, অপবিত্র কৌতূহল লইয়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারিব না। ওই দেখো, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পূজার সুগন্ধি ধূপধুমের ন্যায় সন্ধ্যার বাতাসে মিশাইয়া গেল এবং দুইফোঁঁটা অশ্রুজল দুটি সুকোমল কুসুমকোরকের মতো অজ্ঞাত দেবতার চরণের উদ্দেশে খসিয়া পড়িল।