পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । ১২৯ কাবুলিওয়ালা আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। পথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসর কাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মহন্ত মৌনভাবে নষ্ট করে না। তাহার মা অনেক সময় ধমক দিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেয়, কিন্তু আমি তাহা পারি না। মিনি চুপ করিয়া থাকিলে এমনি অস্বাভাবিক দেখিতে হয় যে, সে আমার বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। এইজন্য আমার সঙ্গে তাহার কথোপকথনটা কিছর উৎসাহের সহিত চলে। সকালবেলায় আমার নভেলের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে হাত দিয়াছি এমন সময় মিনি আসিয়াই আরম্ভ করিয়া দিল, “বাবা, রামদয়াল দরোয়ান কাককে কেীয়া বলছিল, সে কিচ্ছ জ্ঞানে না। না ?” , আমি পথিবীতে ভাষার বিভিন্নতা সম্বন্ধে তাহাকে জ্ঞানদান করিতে প্রবত্ত হইবার পতবেই সে দ্বিতীয় প্রসঙ্গে উপনীত হইল। “দেখো বাবা, ভোলা বলছিল আকাশে হাতি শ:ড় দিয়ে জল ফেলে, তাই ব্যষ্টি হয় । মা গো, ভোলা এত মিছিমিছি বকতে পারে ; কেবলই বকে, দিনরাত বকে ।” এ সম্বন্ধে আমার মতামতের জন্য কিছুমাত্র অপেক্ষা না করিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, “বাবা, মা তোমার কে হয় ।” মনে মনে কহিলাম, শ্যালিকা ; মুখে কহিলাম, ‘মিনি, তুই ভোলার সঙ্গে খেলা করা গে যা। আমার এখন কাজ আছে।” সে তখন আমার লিখিবার টেবিলের পাবে আমার পায়ের কাছে বসিয়া নিজের দুই হাঁট এবং হাত লইয়া অতিদ্রুত উচ্চারণে আগডুম-বাগডুম খেলিতে আরম্ভ করিয়া দিল। আমার সপ্তদশ পরিচ্ছেদে প্রতাপসিংহ তখন কাঞ্চনমালাকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কারাগারের উচ্চ বাতায়ন হইতে নিম্নবতী নদীর জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িতেছেন। আমার ঘর পথের ধারে। হঠাৎ মিনি আগডুম-বাগডুম খেলা রাখিয়া জানালার ধারে ছটিয়া গেল এবং চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, “কাবলিওয়ালা, ও কাবলিওয়ালা।” ময়লা ঢিলা কাপড় পরা, পাগড়ি মাথায়, কলি ঘাড়ে, হাতে গোটাদই-চার আঙুরের বাক্স, এক লম্বা কাবুলিওয়ালা মন্দমন্দ গমনে পথ দিয়া যাইতেছিল— তাহাকে দেখিয়া আমার কন্যারত্বের কিরুপ ভাবোদয় হইল বলা শক্ত, তাহাকে উধৰবাসে ডাকাডাকি আরম্ভ করিয়া দিল। আমি ভাবিলাম, এখনই বুলি ঘাড়ে একটা আপদ আসিয়া উপস্থিত হইবে, আমার সপ্তদশ পরিচ্ছেদ আর শেষ হইবে না। কিন্তু, মিনির চীৎকারে যেমনি কাবলিওয়ালা হসিয়া মুখ ফিরাইল এবং আমাদের বাড়ির দিকে আসিতে লাগিল অমনি সে উধনশ্বাসে অতঃপরে দৌড় দিল, তাহার আর চিহ্ন দেখিতে পাওয়া গেল না। তাহার মনের মধ্যে একটা অন্য বিশ্বাসের মতো ছিল যে, ওই ঝলিটার ভিতর সন্ধান করিলে তাহার মতো দটো-চারটে জীবিত মানবসন্তান পাওয়া যাইতে পারে। ৯