পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>○bf গল্পগুচ্ছ ফটিককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন রে ফটিক, মামার সঙ্গে কলকাতায় যাবি?” ফটিক লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, “যাব।” যদিও ফটিককে বিদায় করিতে তাহার মায়ের আপত্তি ছিল না, কারণ তাঁহার মনে সবদাই আশঙ্কা ছিল— কোন দিন সে মাখনকে জলেই ফেলিয়া দেয় কি মাথাই ফাটায়, কি কী একটা দীঘটনা ঘটায়, তথাপি ফটিকের বিদায়গ্রহণের জন্য এতাদশ আগ্রহ দেখিয়া তিনি ঈষৎ ক্ষম হইলেন। কবে যাবে’ কখন যাবে’ করিয়া ফটিক তাহার মামাকে অস্থির করিয়া তুলিল; উৎসাহে তাহার রাত্রে নিদ্রা হয় না। অবশেষে যাত্রাকালে আনন্দের ঔদায* -বশত তাহার ছিপ ঘড়ি লাটাই সমস্ত মাখনকে পত্রপৌত্রাদিক্ৰমে ভোগদখল করিবার পরো অধিকার দিয়া গেল। কলিকাতায় মামার বাড়ি পৌছিয়া প্রথমত মামীর সঙ্গে আলাপ হইল। মামী এই অনাবশ্যক পরিবারবন্ধিতে মনে-মনে যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন তাহা বলিতে পারি না। তাঁহার নিজের তিনটি ছেলে লইয়া তিনি নিজের নিয়মে ঘরকন্না পাতিয়া বসিয়া আছেন, ইহার মধ্যে সহসা একটি তেরো বৎসরের অপরিচিত অশিক্ষিত পাড়াগোঁয়ে ছেলে ছাড়িয়া দিলে কিরুপ একটা বিপ্লবের সম্ভাবনা উপস্থিত হয়। বিশ্বভরের এত বয়স হইল, তব কিছুমাত্র যদি জ্ঞানকাণ্ড আছে। বিশেষত, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই অাব নাই । শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না । স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রাথনীয় নহে। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠাম এবং কথামাত্রই প্ৰগলভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না কবিয়া বেমানানরপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী পধাস্ববপে জ্ঞান করে । তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কন্ঠস্বরের মিস্টতা সহসা চলিয়া যায় ; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে-মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবাষ তাটিও যেন অসহ্য বোধ হয়। সেও সব দা মনে-মনে বুঝিতে পারে, পথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সবাদা লজিত ও ক্ষমাপ্রাথী হ ইয়া থাকে । অথচ, এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহদেয় ব্যক্তির নিকট হইতে সেনহ কিবা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়। অতএব, এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত পথান বালকের পক্ষে নরক। চারি দিকের স্নেহশন্য বিরাগ তাহাকে পদে পদে কাঁটার মতো বিধে । এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ বগলোকের দলভ জীব বলিয়া মনে ধারণ হইতে আরম্ভ হয়, অতএব তাঁহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয়।