পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মধ্যবতিনী Stుపి ভাসিতেছিল। মনে হইয়াছিল, “আমার যেন কিছুই না হইলেও চলে। ক্ৰমে শরীর বলী হইয়া উঠিল, রক্তের তেজ বাড়িতে লাগিল, তখন হরসন্দেরীর মনে কোথা হইতে একদল শরিক আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহারা উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “তুমি তো ত্যাগপত্র লিখিয়া বসিয়া আছ, কিন্তু আমাদের দাবি আমরা ছাড়িব না।’ হরসন্দরী যে দিন প্রথম পরিকাররপে আপন অবস্থা বঝিতে পারিল সে দিন নিবারণ ও শৈলবালাকে আপন শয়নগহে ছাড়িয়া দিয়া ভিন্ন গহে একাকিনী গিয়া শয়ন করিল। আট বৎসর বয়সে বাসররাত্রে যে শয্যায় প্রথম শয়ন করিয়াছিল, আজ সাতাশ বৎসর পরে, সেই শয্যা ত্যাগ করিল। প্রদীপ নিভাইয়া দিয়া এই সধবা রমণী যখন অসহ্য হন্দয়ভার লইয়া তাহার নতন বৈধব্যশয্যার উপরে আসিয়া পড়িল তখন গলির অপর প্রান্তে একজন শৌখিন যবো বেহাগ রাগিণীতে মালিনীর গান গাহিতেছিল; আর-একজন বাঁয়া-তবলায় সংগত করিতেছিল এবং শ্রোতৃবন্ধগণ সমের কাছে হা-হাঃ করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেছিল। তাহার সেই গান সেই নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নারাত্রে পাশেবার ঘরে মন্দ শনাইতেছিল না। তখন বালিকা শৈলবালার ঘামে চোখ ঢলিয়া পড়িতেছিল, আর নিবারণ তাহার কানের কাছে মুখ রাখিয়া ধীরে ধীরে ডাকিতেছিল, “সই!” লোকটা ইতিমধ্যে বঙ্কিমবাবর চন্দ্রশেখর পড়িয়া ফেলিয়াছে এবং দই-একজন আধুনিক কবির কাব্যও শৈলবালাকে পড়িয়া শনাইয়াছে। নিবারণের জীবনের নিম্নস্তরে যে একটি যৌবন-উৎস বরাবর চাপা পড়িয়া ছিল আঘাত পাইয়া হঠাৎ বড়ো অসময়ে তাহা উচ্ছসিত হইয়া উঠিল। কেহই সেজন্য প্রস্তুত ছিল না, এই হেতু অকস্মাৎ তাহার বন্ধিশান্ধি এবং সংসারের সমস্ত বন্দোবস্ত উলটাপালটা হইয়া গেল। সে বেচারা কোনোকালে জানিত না, মানুষের ভিতরে এমন-সকল উপদ্রবজনক পদার্থ থাকে, এমন-সকল দাদাম দুরন্ত শক্তি যাহা সমস্ত হিসাব-কিতাব শঙ্খেলা-সামঞ্জস্য একেবারে নয়-ছয় করিয়া দেয় । কেবল নিবারণ নহে, হরসন্দেরীও একটা নতন বেদনার পরিচয় পাইল। এ কিসের আকাঙ্ক্ষা, এ কিসের দুঃসহ যন্ত্রণা। মন এখন যাহা চায় কখনো তো তাহা চাহেও নাই, কখনো তো তাহা পায়ও নাই। যখন ভদ্রভাবে নিবারণ নিয়মিত আপিসে যাইত, যখন নিদ্রার পাবে কিয়ংকালের জন্য গয়লার হিসাব, প্রব্যের মহাঘতা এবং লৌকিকতার কতব্য সবন্ধে আলোচনা চলিত, তখন তো এই অন্তর বিপ্লবের কোনো সত্রপাতমাত্র ছিল না। ভালোবাসিত বটে, কিন্তু তাহার তো কোনো উজ্জলতা, কোনো উত্তাপ ছিল না। সে ভালোবাসা অপ্রজবলিত ইন্ধনের মতো ছিল মাত্র। আজ তাহার মনে হইল, জীবনের সফলতা হইতে যেন চিরকাল কে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া আসিয়াছে। তাহার হাদয় যেন চিরদিন উপবাসী হইয়া আছে। তাহার এই নারীজীবন বড়ো দারিদ্রোই কাটিয়াছে। সে কেবল হাটবাজার পানমসলা তরিতরকারির ঝঞ্জাট লইয়াই সাতাশটা অমল্য বৎসর দাসীবত্তি করিয়া কাটাইল, আর আজ জীবনের মধ্যপথে আসিয়া দেখিল তাহারই শয়নকক্ষেয় পাশেৰ এক গোপন মহামহৈশ্বয'ভান্ডারের কুলপ খলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালিকা একেবারে রাজরাজেশ্বরী হইয়া বসিল। নারী দাসী বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে নারী রানীও বটে। কিন্তু ভাগাভাগি