পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૨૪ গল্পগুচ্ছ তাঁহার বারা হইয়া উঠে না। চোখে কম দেখেন বলিয়া চেনা লোককে চিনিতে পারেন না এবং সেই কারণেই ভ্র কুঞ্চিত করিয়া দষ্টিপাত করিতে হয়, লোকে সেটাকে ঔন্ধত্য বলিয়া বিবেচনা করে। কলিকাতায় জনসমুদ্রের মধ্যে আপন-মনে একলা থাকা শোভা পায় কিন্তু পল্লীগ্রামে সেটা বিশেষ সপধার মতো দেখিতে হয়। শশিভূষণের বাপ যখন বিস্তর চেষ্টায় পরাস্ত হইয়া অবশেষে তাঁহার অকমাণ্য পত্রটিকে পল্লীতে তাঁহাদের সামান্য বিষয়রক্ষাকাষে নিয়োগ করিলেন তখন শশিভূষণকে পল্লীবাসীদের নিকট হইতে বিস্তর উৎপীড়ন উপহাস এবং লাঞ্ছনা সহিতে হইয়াছিল। লাঞ্ছনার আরও একটা কারণ ছিল ; শান্তিপ্রিয় শশিভূষণ বিবাহ করিতে সম্মত ছিলেন না-কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাগণ তাঁহার এই অনিচ্ছাকে দুঃসহ অহংকার জ্ঞান করিয়া কিছুতেই ক্ষম করিতে পারিতেন না। শশিভূষণের উপর যতই উপদ্রব হইতে লাগিল শশিভূষণ ততই আপন বিবরের মধ্যে আদশ্য হইতে লাগিলেন। একটি কোণের ঘরে তক্তপোষের উপর কতকগুলি বাঁধানো ইংরাজি বই লইয়া বসিয়া থাকিতেন । যখন যেটা ইচ্ছা হইত পাঠ করিতেন, এই তো ছিল তাঁর কাজ— বিষয় কী করিয়া রক্ষা হইত তাহা বিষয়ই জানে । এবং পবেই আভাসে বলা গিয়ছে, মানুষের মধ্যে তাঁহাব সম্পক ছিল কেবল গিরিবালার সহিত । গিরিবালার ভাইরা ইসকুলে যাইত এবং ফিরিয়া আসিযা মড় ভগ্নীটিকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করিত, পথিবীব আকবি কিবাপ কোনোদিন বা প্রশ্ন করিত, সন্য বড়ো না পথিবী বড়ো— সে যখন ভুল বলিত তখন তাহ’ব প্রতি বিপুল অবজ্ঞা দেখাইয়া ভ্রম সংশোধন করিত। সদ্য পৃথিবী অপেক্ষ বহং, এ মতটা যদি গিরিবালার নিকট প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ বলিয়া বোধ হইত এবং সেই সন্দেহ যদি সে সাহস করিয়া প্রকাশ করিত তবে তাহার ভাইরা তাহাকে বিগণ উপেক্ষাভরে কহিত, “ইস ! আমাদের বইয়ে লেখা আছে আর তুই--" ছাপার বইয়ে এমন কথা লেখা আছে শুনিয়া গিরিবালা সম্পণে নিরক্তের হইয়া ষাইত, দ্বিতীয় আর-কোনো প্রমাণ তাহার নিকট আবশ্যক বোধ হইত না । কিন্তু তাহার মনে মনে বড়ো ইচ্ছা করিত, সেও দাদীদের মতো বই লইয়া পড়ে। কোনো-কোনোদিন সে আপন ঘরে বসিয়া কোনো-একটা বই খালিয়; বিড় বিড় করিয়া পড়ার ভান করিত এবং অনগাল পাতা উলটাইয়া বাইত। ছাপার কালো কালো ছোটো ছোটো অপরিচিত অক্ষরগুলি কী যেন এক মহারহস্যশালার সিংহদ্বারে দলে দলে সার বধিয়া কন্ধের উপরে ইকার ঐকার রেফ উ'চাইয়া পাহারা দিত, গিরিবালার কোনো প্রশ্নের কোনোই উত্তর করিত না। কথামালা তাহার ব্যাঘ্র শগোল অথব গদ্যভের একটি কথাও কৌতহলকাতর বালিকার নিকট ফাঁস করিত না এবং আখ্যানমঞ্জরী তাহার সমস্ত আখ্যানগুলি লইয়া মৌনত্ততের মতো নীরবে চাহিয়া থাকিত । গিরিবালা তাহার ভাইদের নিকট পডা শিখিবার প্রস্তাব করিয়াছিল কিন্তু তাহার ভাইরা সে কথায় কৰ্ণপাতমাত্র করে নাই ; একমাত্র শশিভূষণ তাহার সহায় ছিল। গিরিবালার নিকট কথামালা এবং আখ্যানমঞ্জরী যেমন দাভেদ্য রহস্যপণ ছিল শশিভূষণও প্রথম প্রথম অনেকটা সেইরাপ ছিল। লোহার গরাদে-দেওয়া রাস্তার ধারের