পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মেঘ ও রৌদ্র ૨86 লেখা—গিরিবালা দেবী। খাতা ও বইগুলির উপরেও ঐ এক হস্তাক্ষরে এক নাম লিখিত। শশিভূষণ কোথায় আসিয়াছেন বঝিতে পারিলেন। তাঁহার বক্ষের মধ্যে রক্তস্রোত তরঙ্গিত হইয়া উঠিল। মন্ত বাতায়ন দিয়া বাহিরে চাহিলেন—সেখানে কী চক্ষে পড়িল। সেই ক্ষুদ্র গরাদে-দেওয়া ঘর, সেই অসমতল গ্রাম্য পথ, সেই ডুরে-কাপড়-পরা ছোটো মেয়েটি। এবং সেই আপনার শান্তিময় নিশ্চিত নিভৃত জীবনযাত্রা। সেদিনকার সেই সখের জীবন কিছুই অসামান্য বা অত্যধিক নহে; দিনের পর দিন ক্ষুদ্র কাজে ক্ষুদ্র সুখে অজ্ঞাতসারে কাটিয়া যাইত, এবং তাঁহার নিজের অধ্যয়নকাষের মধ্যে একটি বালিকা ছাত্রীর অধ্যাপনকার্য তুচ্ছ ঘটনার মধ্যেই গণ্য ছিল; কিন্তু গ্রামপ্রান্তের সেই নিজন দিনযাপন, সেই ক্ষুদ্র শান্তি, সেই ক্ষুদ্র সখে, সেই ক্ষুদ্র বালিকার ক্ষুদ্র মুখখানি সমস্তই যেন স্বগের মতো দেশকলের বহিভূত এবং আয়ত্তের অতীত রূপে কেবল আকাঙ্ক্ষারাজ্যের কল্পনাছায়ার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল । সেদিনকার সেই-সমস্ত ছবি এবং সমৃতি আজিকার এই বর্ষালান প্রভাতের আলোকের সহিত এবং মনের মধ্যে মদগঞ্জিত সেই কাঁতানের গানের সহিত জড়িত মিশ্রিত হইয়া একপ্রকার সংগীতময় জ্যোতিময় অপবরুপ ধারণ করিল। সেই জঙ্গলে বেষ্টিত, কদমাক্ত, সংকীর্ণ গ্রামপথের মধ্যে সেই অনাদত ব্যথিত বালিকার অভিমানমলিন মুখের শেষ সমতিটি যেন বিধাতাবিরচিত এক অসাধারণ আশ্চর্য অপরুপ অতি-গভীর অতিবদনপরিপািণ সবগীয় চিত্রের মতো তাঁহার মানসপটে প্রতিফলিত হইয়া উঠিল। তাহারই সঙ্গে কাঁতানের করণ স.র বজিতে লাগিল এবং মনে হইল যেন সেই পল্লীবালিকার মুখে সমস্ত বিশ্ববহ িদয়ের এক অনিবাচনীয় দুঃখ আপনার ছায়া নিক্ষেপ করিয়াছে। শশিভূষণ দুই বাহর মধ্যে মুখ লুকাইয়; সেই টেবিলের উপর সেই স্লেট বহি খাতার উপর মুখ রাখিয়া অনেক কাল পরে অনেক দিনের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে মদ শব্দে সচকিত হইয়া মুখ তুলিয়া দেখিলেন। তাঁহার সম্মুখে রুপার থালায় ফলমলমিটেন্ন রাখিয়া গিরিবালা আদরে দাঁড় ইয়া নীরবে অপেক্ষা করিতেছিল। তিনি মস্তক তুলিতেই নিরাভরণা শত্রবসন বিধবাবেশধারিণী গিরিবালা তাঁহাকে নতজান হইয়া ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিল। বিধবা উঠিয়া দাঁড়াইয়া যখন শীশ মুখ লানবণ ভগ্নশরীর শশিভূষণের দিকে সকরণ নিধনেত্রে চাহিয়া দেখিল, তখন তাহার দুই চক্ষ ঝরিয়া, দুই কপোল বাহিয়া আশ্রম পড়িতে লাগিল । শশিভূষণ তাহাকে কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু ভাষা খুজিয়া পাইলেন না; নিরন্ধ আশ্রবোপ তাঁহার বকাপথ সবলে অবরোধ করিল, কথা এবং অশ্র উভয়েই নিরপোয়ভাবে হৃদয়ের মুখে কঠের বারে বন্ধ হইয়া রহিল। সেই কাঁতনের দল ভিক্ষা সংগ্ৰহ করিতে করিতে আটালিকার সম্মখে আসিয়া দাঁড়াইল এবং পুনঃ পানঃ আবত্তি করিয়া গাহিতে লাগিল— এসো এসো হে! আশ্বিন-কাতি'ক ১৩০১