পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯২ গল্পগুচ্ছ বেষ্টন করিয়া সেই দড়ি কুন্দদন্তপংক্তিতে দংশন করিয়া ধরে, দই বাহ উধেৰ তুলিয়া মস্তকের পশ্চাতে বেণীগুলিকে দঢ় আকষাণে কুণ্ডলায়িত করে— চুল বাঁধা শেষ করিয়া হাতের সমস্ত কাজ ফরাইয়া যায়— তখন সে আলস্যভরে কোমল বিছানার উপরে আপনাকে পত্রান্তরালচু্যত একটি জ্যোৎসনালেখার মতো বিস্তীণ করিয়া দেয়। তাহার সন্তানাদি নাই, ধনিগহে তাহার কোনো কাজকম"ও নাই— সে কেবল নিজনে প্রতিদিন আপনার মধ্যে আপনি সচিত হইয়া শেষকালে আপনাকে আর ধারণ করিয়া রাখিতে পারিতেছে না। স্বামী আছে, কিন্তু সবামী তাহার আয়ত্তের মধ্যে নাই। গিরিবালা বাল্যকাল হইতে যৌবনে এমন পণবিকশিত হইয়া উঠিয়াও কেমন করিয়া তাহার স্বামীর চক্ষ এড়াইয়া গেছে। বরঞ্চ বাল্যকালে সে তাহার স্বামীর আদর পাইয়াছিল। স্বামী তখন ইস্কুল পালাইয়া, তাহার সপত অভিভাবকদিগকে বঞ্চনা করিয়া, নিজন মধ্যাহ্নে তাহার বালিকা সত্রীর সহিত প্রণয়ালাপ করিতে আসিত । এক বাড়িতে থাকিয়াও শৌখিন চিঠির কাগজে সীর সহিত চিঠিপত্র-লেখালেখি করিত। ইসকুলের বিশেষ বন্ধ দিগকে সেইসমস্ত চিঠি দেখাইয়া গব অনুভব করিত ! তুচ্ছ এবং কপিত কারণে মন্ত্রীর সহিত মান-অভিমানেরও অসদ্ভাব ছিল না। এমন সময়ে বাপের মৃত্যুতে গোপীনাথ স্বয়ং বড়ির কত হইয়া উঠিল । কাঁচ: কাঠের তক্তায় শীঘ্ৰ পোকা ধরে— কাঁচা বয়সে গোপীনাথ যখন স্বাধীন হইয়া উঠিল তখন অনেকগুলি জীবজন্তু তাহার কন্ধে বাস করিল। তখন ক্ৰমে অন্তঃপরে তাহার গতিবিধি হাস হইয়া অন্যত্র প্রসারিত হইতে লাগিল । দলপতিত্বের একটা উত্তেজনা আছে : মানুষের কাছে মালযেব নেশটা অত্যন্ত বেশি। অসংখ্য মনুষ্যজীবন এবং সবিস্তীর্ণ ইতিহাসের উপর আপন প্রভাব বিস্তার করিবার প্রতি নেপোলিয়নের যে-একটা প্রবল আকষণ ছিল— একটি ছোটো বৈঠক খানার ছোটো কতাটিরও নিজের ক্ষুদ্র দলের নেশা অলপতর পরিমাণে সেই একজাতীয়। সামান্য ইয়াকি-বন্ধনে আপনার চারি দিকে একটা লক্ষীছাড়া ইয়ারমণ্ডলী সজন করিয়া তুলিলে তাহদের উপর আধিপত্য এবং তাহদের নিকট হইতে লাহ ব: লাভ করা একটা প্রচণ্ড উত্তেজনার কারণ হইয়া দাঁড়ায় , সেজন্য অনেক লোক বিষয়নাশ, ঋণ, কলঙ্ক, সমস্তই স্বীকার করিতে প্রস্তুত হয় । গোপীনাথ তাহার ইয়ার-সম্প্রদায়ের অধ্যক্ষ হইয়া ভারি মহিয়া উঠিল। সে প্রতিদিন ইয়াকির নব নব কীতি, নব নব গৌরবলাভ করিতে লাগিল। তাহাব দলের লোক বলিতে লাগিল— শ্যালকবগের মধ্যে ইয়াকিতে অদ্বিতীয় খ্যাতিলাভ করিল গোপীনাথ। সেই গবে, সেই উত্তেজনায় অন্যান্য সমস্ত সুখ দুঃখ কতবোর প্রতি অন্ধ হইয়া হতভাগ্য ব্যক্তিটি রাত্রিদিন আবতের মঙে পাক খাইয়া-খাইয়া বেড়াইতে লাগিল । এ দিকে জগন্জয়ী রাপ লইয়া আপন অন্তঃপুরের প্রজাহীন রাঙ্গো, শয়নগাহের শন্য সিংহাসনে গিরিবালা অধিষ্ঠান করিতে লাগিল। সে নিজে জানিত, বিধাতা তাহার হস্তে রাজদণ্ড দিয়াছেন—সে জনিত, প্রাচীরের ছিদ্ৰ দিয়া যে বহৎ জগৎখানি দেখা যাইতেছে সেই জগৎটিকে সে কটাক্ষে জয় করিয়া আসিতে পারে— অথচ বিশ্বসংসারের মধ্যে একটি মানুষকেও সে বন্দী করিতে পারে নাই।