পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ο & Ο গল্পগুচ্ছ ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পনরায় ফিরিয়া বসিতেই, একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল—যেন অনেকে মিলিয়া ছাটাছুটি করিয়া নামিয়া আসিতেছে। ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরপ পলক মিশ্রিত হইয়া আমার সবাঙ্গ পরিপণ করিয়া তুলিল। যদিও আমার সম্মখে কোনো মতি ছিল না তথাপি পটে প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়াহ্নে একদল প্রমোদচঞ্চল নারী শস্তোর জলের মধ্যে স্নান করিতে নামিয়াছে। যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ গিরিতটে, নদীতীরে, নিজন প্রাসাদে কোথাও কিছমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন পস্ট শনিতে পাইলাম নিঝরের শতধারার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরপরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া আমার পাশ্ব দিয়া সনানাথিনীরা চলিয়া গেল। আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না। তাহারা যেমন আমার নিকট অদশ্য, আমিও যেন সেইরুপ তাহাদের নিকট অদশ্য। নদী পববৎ সিথর ছিল, কিন্তু আমার নিকট পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহবিক্ষেপে বিক্ষব্ধ হইয়া উঠিয়াছে, হাসিয়া হাসিয়া সখীগণ পরম্পরের গায়ে জল ছড়িয়া মারিতেছে এবং সতরণকারিণীদের পদাঘাতে জলবিন্দরাশি মন্তোমটির মতো আকাশে ছিটিয়া পড়িতেছে। আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতুহলের, ঠিক বলিতে পারি না। বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল, ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছই ছিল না ; মনে হইল, ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই পষ্ট শোনা যাইবে— কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায় । মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দলিতেছে, ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দটিপাত করি—সেখানে বহৎ সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছই দেখা যায় না । হঠাৎ গমোট ভাঙিয়া হা হা করিয়া একটা বাতাস দিল— শস্তোর স্থির জলতল দেখিতে দেখিতে অপসরীর কেশদামের মতো কুচিত হইয়া উঠিল, এবং সন্ধ্যাছায়াচ্ছন্ন সমস্ত বনভূমি এক মহতে একসঙ্গে মমরধৰনি করিয়া যেন দঃস্বপন হইতে জাগিয়া উঠিল। সবগুনই বলো আর সত্যই বলো, আড়াই শত বৎসরের অতীত ক্ষেত্র হইতে প্রতিফলিত হইয়া আমার সম্মুখে যে-এক অদশ্য মরীচিকা অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা চকিতের মধ্যে অন্তহিত হইল। যে মায়াময়ীরা আমার গায়ের উপর দিয়া দেহহীন দ্রতপদে শব্দহীন উচ্চকলহাস্যে ছটিয়া শস্তোর জলের উপর গিয়া ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াছিল, তাহারা সিন্ত অঞ্চল হইতে জল নিকষণ করিতে করিতে আমার পাশ দিয়া উঠিয়া গেল না। বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়, বসন্তের এক নিশবাসে তাহারা তেমনি করিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল। তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নিজন পাইয়া কবিতাদেবী আমার কন্ধে আসিয়া ভর করিলেন। আমি বেচারা তুলার মাশলৈ আদায় করিয়া খাটিয়া খাই, সবনাশিনী এইবার বঝি আমার মন্ডপাত করিতে আসিলেন। ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে: শান্য উদরেই সকল প্রকার দরোরোগ্য রোগ আসিয়া চাপিয়া ধরে। আমার পাচকটিকে ডাকিয়া প্রচুরঘতপক মসলা-সগন্ধি রীতিমত মোগলাই খানা হঝুেম করিলাম।