পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অধ্যাপক 《C) 4 নিভৃত প্রদোষাধকার; মমরিত ঘনপল্লবের দীর্ঘনিশবাসে, তরতলবিচু্যত বকুলফলের নিবিড় সৌরভে এবং সন্ধারণ্যের স্তম্ভিত সংযত নিঃশব্দতায় তাহা রোমে রোমে পরিপাপ হইয়া ছিল। তাহারই মাঝখানটিতে আমার কুমারী প্রতিবেশিনী তাহার শেবতশমশ্র বন্ধ পিতার দক্ষিণ হস্ত ধরিয়া ধীরে ধীরে পদচারণা করিতে করিতে কী কথা কহিতেছিল— বন্ধ সনেহে অথচ শ্রদ্ধাভরে ঈষৎ অবনমিত হইয়া নীরবে মনোযোগসহকারে শনিতেছিলেন । এই পবিত্র স্নিগধ বিশ্রম্মভালাপে ব্যাঘাত করিবার কিছই ছিল না, সন্ধ্যাকালের শান্ত নদীতে কচিং দাঁড়ের শব্দ সদরে বিলীন হইতেছিল এবং অবিরল তরশোখার অসংখ্য নীড়ে দটি-একটি পাখি দৈবাৎ ক্ষণিক মদকোকলীতে জাগিয়া উঠিতেছিল। আমার অন্তঃকরণ আনন্দে অথবা বেদনায় যেন বিদীণ হইবে মনে হইল। আমার অস্তিত্ব যেন প্রসারিত হইয়া সেই ছায়ালোকবিচিত্র ধরণীতলের সহিত এক হইয়া গেল, আমি যেন আমার বক্ষঃস্থলের উপর ধীরবিক্ষিপ্ত পদচারণা অনুভব করিতে লাগিলাম, যেন তর-পল্লবের সহিত সংলগ্ন হইয়া গিয়া আমার কানের কাছে মধরে মদগঞ্জেনধৰনি শনিতে পাইলাম। এই বিশাল মঢ়ে প্রকৃতির অন্তবেদনা যেন আমার সব শরীরের অস্থিগুলির মধ্যে কুহরিত হইয়া উঠিল; আমি যেন বঝিতে পারিলাম, ধরণী পায়ের নীচে পড়িয়া থাকে অথচ পা জড়াইয়া ধরিতে পারে না বলিয়া ভিতরে ভিতরে কেমন করিতে থাকে, নতশাখা বনস্পতিগুলি কথা শুনিতে পারে অথচ কিছুই বকিতে পারে না বলিয়া সমস্ত শাখায় পল্লবে মিলিয়া কেমন উধত্বশবাসে উন্মাদ কলশব্দে হাহাকার করিয়া উঠিতে চাহে । আমিও আমার সবাঙ্গে সবান্তঃকরণে ঐ পদবিক্ষেপ, ঐ বিশ্রম্মভালাপ অব্যবহিতভাবে অনুভব করিতে লাগিলাম, কিন্তু কোনোমতেই ধরিতে পারিলাম না বলিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া মরিতে লাগিলাম। পরদিন আমি আর থাকিতে পারিলাম না। প্রাতঃকালে আমার প্রতিবেশীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। ভবনাথবাব তখন বড়ো এক পেয়ালা চা পাশে রাখিয়া চোখে চশমা দিয়া নীল পেন্সিলে দাগ-করা একখানা হ্যামিলটনের পরাতন পুথি মনোযোগ দিয়া পড়িতেছিলেন। আমি ঘরে প্রবেশ করিলে চশমার উপরিভাগ হইতে আমাকে কিয়ৎক্ষণ অন্যমনস্কভাবে দেখিলেন, বই হইতে মনটাকে এক মহতে প্রত্যাহরণ করিতে পারিলেন না। অবশেষে অকস্মাং সচকিত হইয়া সতভাবে আতিথ্যের জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠিলেন। আমি সংক্ষেপে আত্মপরিচয় দিলাম। তিনি এমনি শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন যে চশমার খাপ খুজিয়া পাইলেন না। খামকা বলিলেন, “আপনি চা খাইবেন ?" আমি যদিও চা খাই না, তথাপি বলিলাম, “আপত্তি নাই।" ভবনাথবাব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কিরণ কিরণ’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন । বারের নিকট অত্যন্ত মধরে শব্দ শুনিলাম, “কণী, বাবা।” ফিরিয়া দেখিলাম, তাপসক-বদহিতা সহসা আমাকে দেখিয়া বস্ত হরিণীর মতো পলায়নোদ্যতা হইয়াছেন। ভবনাথবাব তাঁহাকে ফিরিয়া ডাকিলেন: আমার পরিচয় দিয়া কহিলেন, “ইনি আমাদের প্রতিবেশী মহীলাকুমারবাবা।” এবং আমাকে কহিলেন, “ইনি আমার কন্যা কিরণবালা।" আমি কী করিব ভাবিয়া পাইতেছিলাম না, ইতিমধ্যে কিরণ আমাকে আনয়সন্দের নমস্কার করিলেন। আমি তাড়াতাড়ি কটি সারিয়া লইয়া তাহা শোধ করিয়া দিলাম। ভবনাথবাব কহিলেন, “মা, মহীলাবাবরে জন্য এক পেয়ালা চা আনিয়া দিতে হইবে।” আমি মনে