পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sos গল্পগুচ্ছ করিল। শনা গেল, অন্দরমহলের গোলসিড়ি দিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে শব্দ উপরে উঠিতেছে। ফণিভূষণ আপনাকে আর দমন করিতে পারে না, তাহার বক্ষ তুফানের ডিঙির মতো আছাড় খাইতে লাগিল এবং নিশ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। গোলসিড়ি শেষ করিয়া সেই শব্দ বারান্দা দিয়া ক্ৰমে ঘরের নিকটবতী হইতে লাগিল। অবশেষে ঠিক সেই শয়নকক্ষের বারের কাছে আসিয়া খটখট এবং ঝমােঝম থামিয়া গেল। কেবল চৌকাঠটি পার হইলেই হয়। ফণিভূষণ আর থাকিতে পারিল না। তাহার রন্ধ আবেগ এক মহতে প্রবলবেগে উচ্ছসিত হইয়া উঠিল, সে বিদদেবেগে চৌকি হইতে উঠিয়া কাঁদিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, মণি! আমনি সচকিত হইয়া জাগিয়া দেখিল, তাহারই সেই ব্যাকুল কণ্ঠের চীৎকারে ঘরের শাসিগলা পর্যন্ত পন্দিত হইতেছে। বাহিরে সেই ভেকের কলরব এবং যাত্রার ছেলেদের ক্লিস্ট কণ্ঠের গান। ফণিভূষণ নিজের ললাটে সবলে আঘাত করিল। পরদিন মেলা ভাঙিয়া গেছে। দোকানি এবং যাত্রার দল চলিয়া গেল। ফণিভূষণ হকুম দিল, সেদিন সন্ধ্যার পর তাহার বাড়িতে সে নিজে ছাড়া আর কেহই থাকিবে না। চাকরেরা সিথর করিল, বাবা তান্ত্রিকমতে একটা কী সাধনে নিযুক্ত আছেন। ফণিভূষণ সমস্ত দিন উপবাস করিয়া রহিল। জনশন্য বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় ফণিভূষণ বাতায়নতলে আসিয়া বসিল। সেদিন আকাশের স্থানে পথানে মেঘ ছিল না, এবং ধৌত নিমলি বাতাসের মধ্য দিয়া নক্ষত্রগলিকে অত্যুক্তজবল দেখাইতেছিল। কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চাঁদ উঠিতে অনেক বিলম্বব আছে। মেলা উত্তীণ হইয়া যাওয়াতে পরিপণ নদীতে নৌকা মাত্রই ছিল না এবং উৎসবজাগরণক্লান্ত গ্রাম দইরাত্রি জাগরণের পর আজ গভীর নিদ্রায় নিমগন। ফণিভূষণ একখানা চৌকিতে বসিয়া চৌকির পিঠের উপর মাথা উধামুখ করিয়া তারা দেখিতেছিল; ভাবিতেছিল, একদিন যখন তাহার বয়স ছিল উনিশ, যখন কলিকাতার কালেজে পড়িত, যখন সন্ধ্যাকালে গোলদিঘির তৃণশয়নে চিত হইয়া হাতের উপরে মাথা রাখিয়া ঐ অনন্তকালের তারাগুলির দিকে চাহিয়া থাকিত এবং মনে পড়িত তাহার সেই নদীকালবতী শবশুরবাড়ির একটি বিরলকক্ষে চোন্দবৎসরের বয়ঃসন্ধিগতা মণির সেই উজল কাঁচা মুখখানি, তখনকার সেই বিরহ কী সমধর, তখনকার সেই তারাগুলির আলোকপন্দন হাদয়ের যৌবনপন্দনের সঙ্গে সঙ্গে কণী বিচিত্র বসন্তরাগেণ যতিতালাভ্যাং’ বাজিয়া বাজিয়া উঠিত! আজ সেই একই তারা আগন দিয়া আকাশে মোহমাগরের শেলাক কয়টা লিখিয়া রাখিয়াছে; বলিতেছে, ‘সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ ! দেখিতে দেখিতে তারাগুলি সমস্ত লাপ্ত হইয়া গেল। আকাশ হইতে একখানা অন্ধকার নামিয়া এবং পথিবী হইতে একখানা অন্ধকার উঠিয়া চোখের উপরকার এবং নিচেকার পল্লবের মতো একত্র আসিয়া মিলিত হইল। আজ ফণিভূষণের চিত্ত শান্ত ছিল। সে নিশ্চয় জানিত, আজ তাহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে, সাধকের নিকট মৃত্যু আপন রহস্য উদঘাটন করিয়া দিবে। পবরাত্রির মতো সেই শব্দ নদীর জলের মধ্য হইতে ঘাটের সোপানের উপর উঠিল। ফণিভূষণ দুই চক্ষ নিমলিত করিয়া স্থির দৃঢ়চিত্তে ধ্যানাসনে বসিল। শব্দ