পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Σ Ο গল্পগুচ্ছ দেখো দেখি, যদি কোনো ডাক্তারের চিকিৎসায় আমার চোখ নষ্ট হইত তাহাতে আমার কী সাক্ষনা থাকিত। ভবিতব্যতা যখন খণ্ডে না তখন চোখ তো আমার কেহই বাঁচাইতে পারিত না, সে চোখ তোমার হাতে গিয়াছে এই আমার অন্ধতার একমাত্র সখ। যখন প্রজায় ফল কম পড়িয়াছিল তখন রামচন্দ্র তাঁহার দুই চক্ষ উৎপাটন করিয়া দেবতাকে দিতে গিয়াছিলেন। আমার দেবতাকে আমার দটি দিলাম— আমার পণিমার জ্যোৎস্না, আমার প্রভাতের আলো, আমার আকাশের নীল, আমার পথিবীর সবুজ সব তোমাকে দিলাম; তোমার চোখে যখন যাহা ভালো লাগিবে আমাকে মুখে বলিয়ো, সে আমি তোমার চোখের দেখার প্রসাদ বলিয়া গ্রহণ করিব।” আমি এত কথা বলিতে পারি নাই, মুখে এমন করিয়া বলাও যায় না; এ-সব কথা আমি অনেকদিন ধরিয়া ভাবিয়াছি। মাঝে মাঝে যখন অবসাদ আসিত, নিষ্ঠার তেজ লান হইয়া পড়িত, নিজেকে বঞ্চিত দঃখিত দভাগ্যদগধ বলিয়া মনে হইত, তখন আমি নিজের মনকে দিয়া এই-সব কথা বলাইয়া লইতাম ; এই শান্তি, এই ভক্তিকে অবলম্বন করিয়া নিজের দুঃখের চেয়েও নিজেকে উচ্চ করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতাম। সে দিন কতকটা কথায় কতকটা নীরবে বোধ করি আমার মনের ভাবটা তাঁহাকে একরকম করিয়া বঝাইতে পারিয়াছিলাম। তিনি কহিলেন, “কুম, মড়তা করিয়া তোমার যা নষ্ট করিয়াছি সে আর ফিরাইয়া দিতে পারিব না, কিন্তু আমার যতদর সাধ্য তোমার চোখের অভাব মোচন করিয়া তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকিব ।” আমি কহিলাম, “সে কোনো কাজের কথা নয়। তুমি যে তোমার ঘরকল্লাকে একটি অন্ধের হাসপাতাল করিয়া রাখিবে, সে আমি কিছুতেই হইতে দিব না। তোমাকে আরএকটি বিবাহ করিতেই হইবে।” কী জন্য যে বিবাহ করা নিতান্ত আবশ্যক তাহা সবিস্তারে বলিবার প্রবে: আমার একটুখানি কন্ঠরোধ হইবার উপক্ৰম হইল। একট কাশিয়া, একটা সামলাইয়া লইয়া বলিতে যাইতেছি, এমনসময় আমার স্বামী উচ্ছসিত আবেগে বলিয়া উঠিলেন, “আমি মঢ়ে, আমি অহংকারী, কিন্তু তাই বলিয়া আমি পাষণ্ড নই। নিজের হাতে তোমাকে অন্ধ করিয়াছি, অবশেষে সেই দোষে তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া যদি অন্য সত্ৰী গ্রহণ করি তবে আমাদের ইস্টদেব গোপীনাথের শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি যেন ব্রহমহত্যা-পিতৃহত্যার পাতকী হই।” এতবড়ো শপথটা করিতে দিতাম না, বাধা দিতাম, কিন্তু অশ্র তখন বক বাহিয়া, কণ্ঠ চাপিয়া, দুই চক্ষ ছাপিয়া, ঝরিয়া পড়িবার জো করিতেছিল ; তাহাকে সবরণ করিয়া কথা বলিতে পারিতেছিলাম না। তিনি যাহা বলিলেন তাহা শনিয়া বিপলে আনন্দের উদবেগে বালিশের মধ্যে মুখ চাপিয়া কাঁদিয়া উঠিলাম। আমি অন্ধ, তব তিনি আমাকে ছাড়িবেন না। দুঃখীর দুঃখের মতো আমাকে হাদয়ে করিয়া রাখিবেন। এত সৌভাগ্য আমি চাই না, কিন্তু মন তো সবাথ পর। অবশেষে অশ্রর প্রথম পশলাটা সবেগে বর্ষণ হইয়া গেলে তাঁহার মাখ আমার বকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিলাম, “এমন ভয়ংকর শপথ কেন করিলে। আমি কি তোমাকে নিজের সখের জন্য বিবাহ করিতে বলিয়াছিলাম। সতিনকে দিয়া আমি আমার সবাথ সাধন করিতাম। চোখের অভাবে তোমার যে কাজ নিজে করিতে পারিতাম না সে আমি তাহাকে দিয়া করাইতাম!”