পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নষ্টনীড় seà চার প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়াছিল সে লিখিবে— অমলকে আশ্চৰ্য করিয়া দিবে; মন্দার সহিত তাহার যে অনেক প্রভেদ এ কথা প্রমাণ না করিয়া সে ছাড়িবে না। এ কয়দিন বিস্তর লিখিয়া সে ছিড়িয়া ফেলিয়াছে। যাহা লিখিতে যায় তাহা নিতান্ত অমলের লেখার মতো হইয়া উঠে; মিলাইতে গিয়া দেখে এক-একটা অংশ আমলের রচনা হইতে প্রায় অবিকল উদ্ধত হইয়া আসিয়াছে। সেইগুলিই ভালো, বাকিগলো কাঁচা। দেখিলে অমল নিশ্চয়ই মনে-মনে হাসিবে, ইহাই কল্পনা করিয়া চার সে-সকল লেখা কুটি কুটি করিয়া ছিড়িয়া পকূরের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে, পাছে তাহার একটা খণ্ডও দৈবাৎ অমলের হাতে আসিয়া পড়ে। প্রথমে সে লিখিয়াছিল ‘শ্রাবণের মেঘ’ । মনে করিয়াছিল, “ভাবাশ্রজেলে অভিষিক্ত খুব-একটা নতন লেখা লিখিয়াছি।” হঠাৎ চেতনা পাইয়া দেখিল জিনিসটা অমলের আষাঢ়ের চাঁদ’-এর এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। অমল লিখিয়াছে, ‘ভাই চাঁদ, তুমি মেঘের মধ্যে চোরের মতো লুকাইয়া বেড়াইতেছ কেন। চার লিখিয়াছিল, সখী কাদম্বিনী, হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া তোমার নীলাঞ্চলের তলে চাঁদকে চুরি করিয়া পলায়ন করিতেছ” ठेउान् ि। কোনোমতেই অমলের গণ্ডি এড়াইতে না পারিয়া অবশেষে চার রচনার বিষয় পরিবতন করিল। চাঁদ, মেঘ, শেফালি, বউ-কথা-কও, এ-সমস্ত ছাড়িয়া সে “কালীতলা’ বলিয়া একটা লেখা লিখিল । তাহাদের গ্রামে ছায়ায়-অন্ধকার পক্রেটির ধারে কালীর মন্দির ছিল; সেই মন্দিরটি লইয়া তাহার বাল্যকালের কল্পনা ভয় ঔৎসুক্য, সেই সম্বন্ধে তাহার বিচিত্র সমতি, সেই জাগ্রত ঠাকুরানীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে গ্রামে চিরপ্রচলিত প্রাচীন গল্প— এইসমস্ত লইয়া সে একটি লেখা লিখিল । তাহার আরম্ভ-ভাগ অমলের লেখার ছাদে কাব্যাড়ম্বরপণ হইয়াছিল, কিন্তু খানিকটা অগ্রসর হইতেই তাহার লেখা সহজেই সরল এবং পল্লীগ্রামের ভাষা-ভঙ্গী-আভাসে পরিপাশ হইয়া উঠিয়াছিল। এই লেখাটা অমল কাড়িয়া লইয়া পড়িল । তাহার মনে হইল, গোড়ার দিকটা বেশ সরস হইয়াছে, কিন্তু কবিত্ব শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয় নাই। যাহা হউক, প্রথম রচনার পক্ষে লেখিকার উদ্যম প্রশংসনীয় । চার কহিল, “ঠাকুরপো, এসো আমরা একটা মাসিক কাগজ বের করি। কী বল।” অমল। অনেকগুলি রৌপ্যচক্ত না হলে সে কাগজ চলবে কী করে। চার । আমাদের এ কাগজে কোনো খরচ নেই। ছাপা হবে না তো— হাতের অক্ষরে লিখব। তাতে তোমার আমার ছাড়া আর কারও লেখা বেরবে না, কাউকে পড়তে দেওয়া হবে না। কেবল দ কপি করে বের হবে; একটি তোমার জন্যে, একটি আমার জন্যে । কিছুদিন পবে হইলে আমল এ প্রস্তাবে মাতিয়া উঠিত; এখন গোপনতার উৎসাহ তাহার চলিয়া গেছে। এখন দশজনকে উদ্দেশ না করিয়া কোনো রচনায় সে সখে পায় না। তব সাবেক কালের ঠাট বজায় রাখিবার জন্য উৎসাহ প্রকাশ করিল। কহিল, “সে বিশ মজা হবে!” চার কহিল, “কিন্তু প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমাদের কাগজ ছাড়া আর কোথাও তুমি লেখা বের করতে পারবে না।” অমল। তা হলে সপাদকেরা যে মেরেই ফেলবে ।