পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মাস্টারমশায় (Q9 à এবারে হরলালের সদাগর-আপিস কী জানি কী কারণে মফস্বল হইতে প্রচুর পরিমাণে চল ডাল খরিদ করিতে প্রবত্ত হইয়াছে। এই উপলক্ষে হরলালকে প্রতি সপ্তাহেই শনিবার ভোরের গাড়িতে সাত-আট হাজার টাকা লইয়া মফস্বলে যাইতে হইত। পাইকেরদিগকে হাতে হাতে দাম চুকাইয়া দিবার জন্য মফস্বলের একটা বিশেষ কেন্দ্রে তাহাদের যে আপিস আছে সেইখানে দশ ও পাঁচ টাকার নোট ও নগদ টাকা লইয়া সে যাইত, সেখানে রসিদ ও খাতা দেখিয়া গত সপ্তাহের মোটা হিসাব মিলাইয়া, বতমান সপ্তাহের কাজ চালাইবার জন্য টাকা রাখিয়া আসিত। সঙ্গে আপিসের দুইজন দরোয়ান যাইত। হরলালের জামিন নাই বলিয়া আপিসে একটা কথা উঠিযাছিল, কিন্তু বড়োসাহেব নিজের উপর সমস্ত ঝ:কি লইয়া বলিয়াছিলেন— হরলালের জামিনের প্রয়োজন নাই । মাঘ মাস হইতে এইভাবে কাজ চলিতেছে, চৈত্র পর্যন্ত চলিবে এমন সম্পভাবনা আছে । এই ব্যাপার লইয়া হরলাল বিশেষ ব্যস্ত ছিল। প্রায়ই তাহাকে অনেক রাত্রে আপিস হইতে ফিরিতে হত । একদিন এইরুপ রাত্রে ফিরিয়া শুনিল, বেণ আসিয়াছিল, মা তাহাকে খাওয়াইয়া যত্ন করিয়া বসাইয়াছিলেন । সেদিন তাহার সঙ্গে কথাবাত গল্প করিয়া তাহার প্রতি তাঁহার মন আরও স্নেহে আকৃষ্ট হইয়াছে । এমন আরও দুই-একদিন হইতে লাগিল। মা বলিলেন, "বাড়িতে মা নাই নাকি, সেইজন্য সেখানে তাহার মন টোকে না। অামি বেণকে তোর ছোটো ভাইয়ের মতো, আপন ছেলের মতোই দেখি । সেই স্নেহ পাইয়া আমাকে কেবল মা বলিয়া ডাকিবার জন্য এখানে আসে।” এই বলিয়া অচিলের প্রান্ত নিয়া তিনি চোখ মছিলেন । হরলালের একদিন বেণর সঙ্গে দেখা হইল। সেদিন সে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল। অনেক রাত পৰ্যন্ত কথাবাত হইল। বেণ বলিল, “বাবা আজকাল এমন হইয়া উঠিয়াছেন যে আমি কিছুতেই বাড়িতে টিকিতে পারিতেছি না। বিশেষত শুনিতে পাইতেছি তিনি বিবাহ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। রতিবাব সম্বন্ধ লইয়া আসিতেছেন— তাঁহার সঙ্গে কেবলই পরামশ চলিতেছে। পাবে আমি কোথাও গিয়া দেরি করিলে বাবা অসিথর হইয়া উঠিতেন, এখন যদি আমি দুই-চারিদিন বাড়িতে না ফিরি তাহা হইলে তিনি আরাম বোধ করেন। আমি বাড়ি থাকিলে বিবাহের আলোচনা সাবধানে করিতে হয় বলিয়া আমি না থাকিলে তিনি হফি ছাড়িয়া বাঁচেন । এ বিবাহ যদি হয় তবে আমি বাড়িতে থাকিতে পারিব না। আমাকে আপনি উদ্ধারের একটা পথ দেখাইয়া দিন— আমি স্বতন্ত হইতে চাই।” নেহে ও বেদনায় হরলালের হদয় পরিপশ হইয়া উঠিল। সংকটের সময় আর সকলকে ফেলিয়া বেণ যে তাহার সেই মাস্টারমশায়ের কাছে আসিয়াছে, ইহাতে কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে তাহার আনন্দ হইল। কিন্তু মাস্টারমশায়ের কতটুকুই বা সাধা আছে ! বেণ কহিল, "যেমন করিয়া হোক, বিলাতে গিয়া বারিস্টার হইয়া আসিলে এই বিপদ হইতে পরিত্রাশ পাই।”