পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হালদারগোষ্ঠী (9එෆ করিবার শক্তি নন্ট হয় নাই। বনোয়ারির প্রধান শখ তিনটি— কুস্তি, শিকার এবং সংস্কৃতচর্চা। তাহার খাতার মধ্যে সংস্কৃত উদ্ভটকবিতা একেবারে বোঝাই করা। বাদলার দিনে, জ্যোৎসনারাত্রে, দক্ষিণা হাওয়ায়, সেগুলি বড়ো কাজে লাগে। সুবিধা এই, নীলকন্ঠ এই কবিতাগুলির অলংকারবাহুল্যকে খব করিতে পারে না। অতিশয়োন্তি যতই অতিশয় হউক, কোনো খাতান্টি-সেরেস্তায় তাহার জন্য জবাবদিহি নাই। কিরণের কানের সোনায় কাপণ্য ঘটে কিন্তু তাহার কানের কাছে যে মন্দাকান্তা গঞ্জেরিত হয় তাহার ছন্দে একটি মারাও কম পড়ে না এবং তাহার ভাবে কোনো মাত্রা থাকে না বলিলেই হয়। লম্ববাচওড়া পালোয়ানের চেহারা বনোয়ারির। যখন সে রাগ করে তখন তাহার ভয়ে লোকে অস্থির। কিন্তু, এই জোয়ান লোকটির মনের ভিতরটা ভারি কোমল । তাহার ছোটো ভাই বংশীলাল যখন ছোটো ছিল তখন সে তাহকে মাতৃস্নেহে লালন করিয়াছে। তাহার হৃদয়ে যেন একটি লালন করিবার ক্ষধা আছে। তাহার সত্রীকে সে যে ভালোবাসে তাহার সঙ্গে এই জিনিসটিও জড়িত, এই লালন করিবার ইচ্ছা। কিরণলেখা তরচ্ছোয়ার মধ্যে পথহারা রশিমরেখাটুকুর মতোই ছোটো, ছোটো বলিয়াই সে তাহার স্বামীর মনে ভারি একটা দরদ জাগাইয়া রাখিয়াছে ; এই সতাঁকে বসনে ভূষণে নানারকম করিয়া সাজাইয়া দেখিতে তাহার বড়ো আগ্রহ। তাহা ভোগ করিবার আনন্দ নহে, তাহা রচনা করিবার আনন্দ, তাহা এককে বহর করিবার আনন্দ, কিরণলেখাকে নানা বণে নানা আবরণে নানারকম করিয়া দেখিবার অনঙ্গদ । কিন্তু কেবলমাত্র সংস্কৃত শেলাক আবত্তি করিয়া বনোয়ারির এই শখ কোনোমতেই মিটিতেছে না। তাহার নিজের মধ্যে একটি পরষোচিত প্রভুশক্তি আছে তাহাও প্রকাশ করিতে পারিল না, আর প্রেমের সামগ্রীকে নানা উপকরণে ঐশ্বযবান করিয়া তুলিবার যে ইচ্ছা তাহাও তার পর্ণ হইতেছে না। এমনি করিয়াই এই ধনীর সন্তান তাহার মানমযাদা, তাহার সন্দেরী সী, তাহার ভরা যৌবন-- সাধারণত লোকে যাহা কামনা করে তাহার সমস্ত লইয়াও সংসারে একদিন একটা উৎপাতের মতো হইয়া উঠিল । সুখদা মধকৈবতের স্ত্রী, মনোহরলালের প্রজা। সে একদিন অতঃপরে আসিয়া কিরণলেখার পা জড়াইয়া ধরিয়া কান্না জড়িয়া দিল। ব্যাপারটা এই— বছর কয়েক পবে নদীতে বেড়জাল ফেলিবার আয়োজন-উপলক্ষে অন্যান্য বারের মতো জেলেরা মিলিযা একযোগে খং লিখিয়া মনোহরলালের কাছারিতে হাজার টাকা ধাব লইয়াছিল। ভালোমতো মাছ পড়িলে সদে আসলে টাকা শোধ করিয়া দিবার কোনো অসী ঘটে না; এইজন্য উচ্চ সদের হারে টাকা লইতে ইহারা চিন্তামাত্র করে না । সে বৎসর তেমন মাছ পড়িল না, এবং ঘটনাক্ৰমে উপরি উপরি তিন বৎসর নদীর বাঁকে মাছ এত কম আসিল যে জেলেদের খরচ পোষাইল না, অধিকন্তু তাহারা ঋণের জালে বিপরীত রকম জড়াইয়া পড়িল। যে-সকল জেলে ভিন্ন এলেকার তাহাদের আর দেখা পাওয়া যায় না; কিন্তু, মধকৈবত ভিটাবাড়ির প্রজা, তাহার পলাইবার জো নাই বলিয়া সমস্ত দেনার দায় তাহার উপরেই চাপিয়াছে। সবনাশ হইতে রক্ষা পাইবার