পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

げピ গল্পগুচ্ছ ঘরে আমি যেমন একলা ছিলাম সেদিন সরবালার ঘরেও সরবালা বোধ করি সেইরাপ একা ছিল। মনে আছে, সেদিন সোমবার। সকাল হইতেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া আছে। বেলা দশটা হইতে টিপটিপ করিয়া ব্যষ্টি পড়িতে আরম্ভ করিল। আকাশের ভাবগতিক দেখিয়া হেডমাস্টার সকাল-সকাল স্কুলের ছটি দিলেন। খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ যেন একটা কী মহা আয়োজনে সমস্ত দিন আকাশময় আনাগোনা করিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার পরদিন বিকালের দিকে মনুষলধারে বটি এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝড় আরম্ভ হইল। যত রাত্রি হইতে লাগিল বটি এবং ঝড়ের বেগ বাড়িতে চলিল। প্রথমে পাব দিক হইতে বাতাস বহিতেছিল, ক্ৰমে উত্তর এবং উত্তরপর্ব দিয়া বহিতে লাগিল । এ রাত্রে ঘনমাইবার চেষ্টা করা ব্যথা। মনে পড়িল, এই দলযোগে সরবালা ঘরে একলা আছে। আমাদের স্কুলঘর তাহাদের ঘরের অপেক্ষা অনেক মজবুত। কতবার মনে করিলাম, তাহাকে স্কুলঘরে ডাকিয়া আনিয়া আমি পাকরিণীর পাড়ের উপর রাত্রিযাপন করিব। কিন্তু কিছুতেই মন সিথর করিয়া উঠিতে পারিলাম না। রাত্রি যখন একটা-দেড়টা হইবে হঠাৎ বানেব ডাক শোনা গেল– সমুদ্র ছটিয়া আসিতেছে। ঘর ছাড়িয়া বাহির হইলাম। সরবালার বাড়ির দিকে চলিলাম। পথে আমাদের পকেরিণীর পাড়—সে পর্যন্ত যাইতে না যাইতে আমার হাঁটজেল হইল । পাড়ের উপর যখন উঠিয়া দাঁড়াইলাম তখন দ্বিতীয় আর-একটা তরঙ্গ আসিয়া উপস্থিত হইল । আমাদের পুকুরের পাড়ের একটা অংশ প্রায় দশ-এগারো হাত উচ্চ হইবে। পাড়ের উপরে আমিও যখন উঠিলাম বিপরীত দিক হইতে আর-একটি লোকও উঠিল। লোকটি কে তাহা আমার সমস্ত অন্তরাত্মা, আমার মাথা হইতে পা পৰ্যন্ত বঝিতে পারিল । এবং সেও যে আমাকে জানিতে পারিল তাহাতে আমার সন্দেহ নাই। আর-সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে, কেবল হাত-পাঁচ-ছয় বীপের উপর আমরা দটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম। তখন প্রলয়কাল, তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে— তখন একটা কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল না— কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেহ কাহাকেও একটা কুশলপ্রশনও করিল না। কেবল দইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম। পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গজন করিয়া ছটিয়া চলিল। আজ সমস্ত বিশ্বসংসার ছাড়িয়া সরবালা আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এক জন্মান্তর, কোন-এক পরাতন রহস্যান্ধকার হইতে ভাসিয়া, এই সন্যচন্দ্রালোকিত লোকপরিপািণ পৃথিবীর উপরে আমারই পাবে আসিয়া সংলগ্ন হইয়াছিল: আর, আজ কত দিন পরে সেই আলোকময় লোকময় পথিবী ছাড়িয়া এই ভয়ংকর জনগন্য প্রলয়ান্ধকারের মধ্যে সরবালা একাকিনী আমারই পাশের আসিয়া উপনীত হইয়াছে। জন্মস্রোতে সেই নবকলিকাকে আমার কাছে আনিয়া