পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪
গোপীচন্দ্রের গান

পাওয়া গেল, তাহাতে আমরা অনুমান করিতে পারি বহু দূরসময়াগত প্রাচীন সংস্কারকে নানা আবর্জ্জনা ও কল্পনা বিকৃত করিয়া দিলেও দেশবাসিগণ প্রাচীন স্মৃতির খেই একবারে হারাইয়া ফেলেন নাই। বিশ্বেশ্বর বাবু তাঁহার ভূমিকায় এটিও প্রমাণ করিয়াছেন যে গোপীচন্দ্রের অনেক কীর্ত্তি উত্তর বঙ্গে থাকিলেও ত্রিপুরা-মেহেরকুলেই তাহার রাজধানী ছিল।

 এই গ্রন্থের ভাষা সম্বন্ধে দুই একটি কথা লেখা দরকার। যদবধি গোবিন্দ্র চন্দ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন, তদবধি এই গান চলিয়া আসিতেছে। কোন করূণ ঘটনার প্রথমোচ্ছ্বাসেই শোক সংগীত রচিত হইয়া থাকে। আজগবী কল্পনা অনেক সময় প্রথম হইতে সুরু হইয়া থাকে। এখনও বাঙ্গালী কয়েকজন সাধু ও মহাপুরুষ সম্বন্ধে তাঁহাদের জীবিতকালে বা মৃতুর অব্যবহিত পরে যে সকল জীবনী রচিত হইয়াছে, তাহাতে আজগবি কথার অন্ত নাই। সুতরাং আজগবী কথা সমসাময়িক হইতে পারে না, তাহা অনেক পরে লিখিত হয়—আমরা এ যুক্তির পক্ষপাতী নহি। রাজার জন্য প্রথম যে বেদনা গাথার আকারে প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই বেদনাজাত কাব্য কথা এপর্য্যন্ত পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি হইয়া আসিতেছে। ইহা শুধু কাব্য নহে—ইহা গান, ইহা লেখা নহে—বাচনিক আবৃত্তি, সুতরাং ইহা যে গায়কের কণ্ঠে যুগে যুগে নূতন ভাষা পরিগ্রহ করিয়াছে তাহতে সন্দেহ নাই। তথাপি ইহা যে অতি প্রাচীন গানের অপেক্ষাকৃত নব সংস্করণ তাহাতে ভুল নাই। অনেক স্থলে প্রাচীন ভাষা পর্য্যন্ত অবিকৃত আছে, আর প্রায় সর্ব্বত্রই ইহাতে প্রাচীন সমাজ ও রীতিনীতির প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। দেব-বিগ্রহ যুগে যুগে নবকলেবর গ্রহণ করিলেও তাহাতে প্রাচীন আদর্শ অনেক সময় বজায় থাকে। এই গানও তদ্রূপ।

 কি কারণে তাহা বলা যায় না, খৃষ্টীয় একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে সমস্ত পৃথিবীময় তন্ত্র, মন্ত্র, পৈশাচিকী ক্ষমতা ও পুরোহিতগণের অদ্ভুত, অলৌকিক শক্তির প্রতি জনসাধারণের মধ্যে একটা অটল বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। গ্যলদিগের ইতিহাসে ড্রুইড-পুরোহিতদের অদ্ভুৎ ক্ষমতার কথা লিপিবদ্ধ আছে। ড্রুইড-পুরোহিতগণ মন্ত্রবলে সমুদ্রের তিমি-তিমিঙ্গলকে ডাকিয়া ডাঙ্গায় আনিতে পারিতেন, তাঁহাদের আদেশে পর্ব্বতের মাথা হেঁট হইয়া