পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মুখবন্ধ

যাইত, তাঁঁহারা অলৌকিক বুভুক্ষায় পীড়িত হইয়া অন্নকুট উদরস্থ করিয়া দুগ্ধের সবোবর পান করিতেন। এই সব গ্যালিক উপাখ্যানের সঙ্গে প্রায় তৎসময়ে বিরচিত “ময়নামতীর গান” পড়িলে উভয়ের সাদৃশ্য আশ্চর্য্যরূপে প্রতীয়মান হয়। হাড়িসিদ্ধার আদেশে ফলবন্ত বৃক্ষের শাখা নত হইয়া ফলের ডালি উপহার দিতেছে, হাড়ি সোণার খড়ম পায় দিয়া দরিয়া পার হইতেছেন, তাহার মুখের কথায় নদী-স্রোত বদ্ধ হইয়া যাইতেছে, স্বয়ং লক্ষ্মীঠাকুরাণী তাহাকে রাঁধিয়া খাওয়াইতেছেন[১]। ইহা ছাড়া আরও কত শত অদ্ভুত কাজ সে করিতেছে। গ্যালিক উপাখ্যানের গুইণবাচের পলায়নের চেষ্টা ও ময়নামতির হস্ত হইতে গোদা যমের উদ্ধারপ্রয়াস একরূপ। সেই উপাখ্যানে টুরিএন পুত্রগণেরও উক্তরূপ চেষ্টা বর্ণিত আছে। এই সাদৃশ্য এত স্পষ্ট—যে মনে হয় যেন পৃথিবীর দুই ভিন্ন প্রান্ত হইতে একই ভাবের গল্পরচকদ্বয় ডাকা ডাকি করিয়া কথা শুনাইতেছেন। “বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে” আমি এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি[২]। গ্যালিক উপাখ্যানের পুরোহিতগণ “হাড়ে মাংসে জোড়া লাগুক”—বলিয়া মন্ত্র পড়িলে, খণ্ডখণ্ডকৃত মৃতদেহ জোড়া লাগিয়া পুনর্জীবিত হইত। আমাদের “ময়নামতী গানের” ন্যায় অনেক বাঙ্গলা কথাসাহিত্যে মন্ত্রের এইরূপ অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় আছে। “গোপীচাঁদের পাঁচালীতে” এইরূপ মৃত দেহে জীবন সঞ্চারের কথা আছে (৩৭৪ পৃঃ)[৩]। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর লৌকিক সাহিত্যে ডাইনী, পুরোহিত ও সিদ্ধাগণের এই অলৌকিক শক্তির কথা পৃথিবীর অনেক স্থলেই পরিদৃষ্ট হয়।

 “ময়নামতীর গান” যখন প্রথম বিরচিত হয়, তখন বঙ্গভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব আদৌ পড়ে নাই। যদি কেহ মনে করেন, নিরক্ষর নিম্ন শ্রেণীর লোক যাহা রচনা করিয়াছে তাহাতে সংস্কৃতের প্রভাব থাকিবে কিরূপে? শুধু এই যুক্তি বলে “ময়নামতীর গানের” প্রাচীনত্ব নির্দ্ধারণ সমীচিন নহে।

  1. গোপীচন্দ্রের গান, বুঝান থণ্ড ৬১পৃঃ।
  2. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, চতুর্থ সংস্করণ, ৬৩ পৃঃ।
  3. “এক হুঙ্কার হাড়ি দিলেন ছাড়িয়া।/স্কন্ধপরে মুণ্ডগোটা পড়ে লম্ফ দিয়া।”