পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গোপীচন্দ্রের গান

 কিন্তু এই গান যে সংস্কৃত-প্রভাব চিহ্নিত যুগের পূর্ব্ববর্ত্তী তাহা অন্য প্রমাণাভাবে শুধু ভাষার প্রমাণেই স্থির করিতে পারা যাইত। সংস্কৃত যুগের নাপিত, ধোপা, মুচি, ডোম প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর বহু কবির রচনা পাওয়া গিয়াছে—তাহাদের লেখা সংস্কৃতের প্রভাব এড়ায় নাই। নিরক্ষর মূর্খ চাষীর রচিত গান পড়ুন—তাহার প্রমাণ পাইবেন। খুব উদ্ভট রকমের হইলেও সংস্কৃত উৎপ্রেক্ষা, উপমা ও যমক অলঙ্কারের বাহুল্য চাষীদের কাব্যেও পাওয়া যায়। সংস্কৃত যুগে লিখিত বঙ্গভাষাকে এতটা সংস্কৃতের অনুযায়ী গড়ন দিয়া তৈরী করা হইয়াছিল যে অশিক্ষিত কবিগণও সেই সংস্কৃত বহুল ভাষা ব্যবহার করিয়াছে। তিলফুলের সঙ্গে নাকের, গজগতির সঙ্গে পাদক্ষেপের, পক্ব বিম্বের সহিত অধরের উপমা চাষীরাও দিতে ছাড়ে নাই। কেষ্টামুচির গানেও বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ ও উপমার নৈপুণ্য দেখা যায়। “ময়নামতীর গান” পড়িলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সংস্কৃত-যুগের বাঙ্গলা হইতে এই বাঙ্গলা ভিন্ন—ইহা পূর্ব্ববর্ত্তী যুগের প্রাকৃত-প্রধান বাঙ্গলা। এই ময়নামতীর গানের সঙ্গে গোরক্ষ-বিজয়, শূন্যপুরাণ, কতকগুলি প্রাচীন ব্রত-কথা, লক্ষ্মী ও সুষ্যের ছড়া, ডাক ও খনার বচন, ভাষা ও ভাব হিসাবে এক পংক্তিতে স্থান পাইবার যোগ্য। এই রচনাগুলিকে শুধু সময়ের পৌর্ব্বাপষ্য অনুসারে বিচার করা যুক্তিযুক্ত নহে। ফয়জুল্লা কিম্বা সুকুর মামুদের রচনা হয়ত দুই তিন শত বৎসরের অধিক প্রাচীন নহে। কিন্তু তথাপি তাহাদের রচনা সংস্কৃত পূর্ব্বযুগের অনুবর্ত্তী; তাহাদের ভাব, ভাষা ও গড়ণ সংস্কৃত যুগের নহে, তৎপূর্ব্ব যুগের। এখনও যেরূপ পাড়গেঁয়ে কবি গণেশ-বন্দনা মুখপাত করিয়া প্রহ্লাদ চরিত্র রচনা করিতে বসিয়া যায়—বঙ্কিম-রবীন্দ্র প্রতিভান্বিত বাঙ্গলার সে কোন ধার ধারে না, কাশীদাসের যুগই তাহার আদর্শ রহিয়াছে—যে পরিবর্ত্তন এই কয়েক শতাব্দী যাবৎ বাঙ্গলা ভাষার উপর খেলিয়া গিয়াছে, সেই গ্রাম্য কবি তাহার কোন খবরই রাখে না,—সেইরূপ এই ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গান রচকগণের অনেকেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে জন্মিলেও তাহারা সেই প্রাচীন যুগের ভাব ও ভাষার আদর্শটা ধরিয়া বসিয়া আছে, সংস্কৃতের প্রভাব তাহারা অগ্রাহ্য করিয়াছে—পৌরাণিক হিন্দুধর্ম্মকে তাহারা গ্রহণ করে নাই, অথবা হিন্দু ধর্ম্মের নব উত্থান তাহাদের দোর পর্যন্ত পৌঁছায় নাই।