পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



মুখবন্ধ

 সম্প্রতি যে ময়মনসিংহ গীতিকা গুলি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার আদর্শ ও সেই প্রাচীন যুগের। যদিও এই গীতিকাগুলি ৩।৪ শত বৎসরের ঊর্দ্ধকালের নহে, তথাপি ইহাদের ভাব ও ভাষা—সংস্কৃত-পূর্ব্ব যুগের।—ইহাদের রচনাকালে বঙ্গের নানা প্রদেশে ভাষার যুগ উল্টিয়া গিয়াছিল, “মুখরুচি কত শুচি”, “অগ্নি অংশু যেন প্রাংশু”, “বিলোলিত পতি আতিরসভাষে।”—প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দের দীপ্তিতে যখন বঙ্গসাহিত্যের একদিক উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল, তখনও পূর্ব যুগের প্রভাব স্বীকার করিয়া এই গীতিকা লেখকগণ,

“গায়ের পাছে আন্ধ্যাপুকুর ঝড়ে জঙ্গলে ঘেরা।
চাইর দিকে কলাগাছ মান্দার গাছের বেড়া”॥

প্রভৃতি ভাষায় কবিতা লিখিতেছিলেন। ইঁহারা বঙ্গসাহিত্যের “পটো”,—এপর্য্যন্ত আর্টস্কুলের পড়ুয়াগণ পটোকে অগ্রাহ্য করিয়া আসিতেছিলেন। সম্প্রতি অবনীবাবুর চিত্রশালার নূতন চিত্রকরগণ যেমন “পটো” দিগকে খুঁজিতেছেন, আমরাও ভাষা-ক্ষেত্রে তেমনই এই হেলে চাষীদিগকে খুঁজিতেছি। বঙ্গভাষার এই সংস্কৃত পূর্ব্ব-যুগ, হেলে চাষী ও কামার কুমারের যুগ। আমরা কিন্তু ব্রাহ্মণ্য-যুগ অপেক্ষা এই হেলে চাষীর যুগের বেশী পক্ষপাতী।

 এই যুগে সাহিত্যের কয়েকটা লক্ষণ আছে, সেই পরীক্ষায় ফেলিয়া ইহাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সাহিত্যের সর্ব্বত্র এক ঘটনার পরে অপর এক ঘটনা বর্ণনা করিতে গেলে, “কোন্‌ কাম করিল” এই ছত্রটি থাকা চাই:—এই যুগের সমস্ত কাব্যে এই মুদ্র-দোষটি আছে। রূপবর্ণনা করিতে গেলে উপমা না দিয়া প্রায়ই জিনিষটা কেমন তাহা বুঝাইবার চেষ্টা আছে, “মেঘের বরণ কন্যার পায়েতে লুটায়” (মলুয়া)—মানে দীঘল চুল। এই সাহিত্যের অন্যতম শাখা গোপীচন্দ্রের গানে আছে—

“যেমন রূপ আছে রাজার পায়ের উপর।
তেমন রূপ নাই তোমার মুখের উপর”॥

রূপ-কথার একটিতে আছে,—

“আঝুরে ঘুমায় কন্যা আলু থালু বেশ।
সারাটি পালঙ্ক জুড়ি আছে কন্যার দীঘল মাথার কেশ॥”