পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



মুখবন্ধ

ছাড়া এই যুগের প্রধান চিহ্ন ও যুগলক্ষণ এই যে এই কবিতা গুলির কোনটিই সংস্কৃত টোলের ধার ধারে না, ইহারা সহর বা নগরের সভ্যতাকে আমল দেয় নাই, ইহারা ভাষা-পল্লব দিয়া ভাবকে লুকাইবার ফন্দি জানেনা, যে কথার কাণাকড়ির মূল্য নাই তাহা গিল্টি করিয়া সাজাইয়া দেখাইবার চেষ্টা করে না—সাহিত্যের সভ্যতা-ভব্যতার ইহারা বড় ধার ধারে না,—জননী ও জন্মভূমি ইহাদিগকে যে ভাষা শিখাইয়াছে তাহা ছাড়িয়া দিয়া পুঁথি লিখিবার সময় অভিধানের বুলি আওড়ায় নাই—ইহারা যে ছবি আঁকে তাহা অতি স্পষ্ট, তাহা বাঙ্গলামায়ের ঘোমটা খুলিয়া তাঁহার স্নেহার্দ্র্য মুখ খানি দেখাইয়া প্রাণ জুড়াইয়া দেয়, পয়ার ও লাচাড়ি ছাড়া ইহারা আর কোন ছন্দের বড় খবর রাখে না। এইরূপ লক্ষণাক্রান্ত কবিতা গুলির শিরোভূষণ ময়মনসিংহের গীতিকা—জঙ্গলে ঢুকিয়া কাঠুরিয়া যেরূপ মাণিক পাইয়াছিল, আমার প্রাচীন সাহিত্যের জঙ্গলের মধ্যে তেমনই এই অমূল্য রত্ন কুড়াইয়া পাইয়াছি। বাঙ্গালার কুঁড়ে ঘরের যে কত দাম,—জগতের কোন রাজ-প্রাসাদের কাছে যে তাহা খাট নহে—এই গীত গুলি তাহা প্রমাণ করিবে।

 গোপীচন্দ্রের গান গুলি ততটা মার্জিত ও সুন্দর না হইলেও তাহা বঙ্গীয় কুটীর গুলির নিখুঁত ছবি আঁকিয়া দেখাইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই—অন্ততঃ এই সকল গানের কথা মাঝে মাঝে এত স্পষ্ট, এত অন্তর-ছোঁয়া, যে আধুনিক কবিরা এত সংক্ষেপে ও এত জোর দিয়া একটা কথা বুঝাইতে পারেন কি না সন্দেহ, আমরা তাহার দুই একটি উদাহরণ দিতেছি—

 ১। রাজা গোপীচন্দ্র ও তাঁহার ভাই খেতুয়া যে এক মায়ের দুগ্ধ খাইয়া বড় হইয়াছে,—খেতুয়া হীন কাজ করে বলিয়া যে সে অশ্রদ্ধেয় নহে—রাজা তাহা রাণীকে বুঝাইতে যাইয়া বলিতেছেন,—

“এক থোবের বাঁশ রাণী নছিবেতে ল্যাখা।
কেও হয় ফুলের সাজি কেহ হাড়ির ঝ্যাঁটা॥”

 এক ঝাড়ের বাঁশ, তথাপি অদৃষ্ট গুণে কোনটাতে ফুলের সাজি তৈরী হয়, কোনটা দিয়া বা হাড়ি ঝাঁটা প্রস্তুত করে।