পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০
গোপীচন্দ্রের গান

 ২। খেতুয়ার গর্ব্ব দেখিয়া এক নাপিত-প্রজা বলিতেছে,—

“ছোট লোকের ছাওয়া যদি বড় বিসই পায়।
টেড়িয়া করি পাগড়ি বাঁধে ছেঞার দিকে চায়॥”
“বাঁশের পাতার ন্যাকান ফ্যারফিরিয়া ব্যাড়ায়।”

ছোটলোকের ছেলে যদি হঠাৎ বড় বিষয়-সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়, তবে পাগড়িটা তির্য্যক ভাবে রচনা করিয়া নিজের ছায়ার দিকে চাহিয়া দেখে কেমন দেখায়, এবং বংশ-পত্রের মতন ফর্ ফর্ করিয়া বেড়ায়।

 এইরূপ নানাবিধ গ্রাম্য কথায় বক্তব্য বিষয় গুলি এরূপ চোখা ও স্পষ্ট করিয়া বলা হয়াছে—যে আধুনিক ভাষাবিৎ তাহার সমস্ত শব্দ সম্পদ লইয়া ও তদপেক্ষা তীব্র ভাবে বক্তব্যটি পরের হৃদয়ঙ্গম করাইতে পারিবেন কিনা, সন্দেহ।

 এই সকল গাথায় প্রাচীন অনেক রীতি পদ্ধতির কথা জানা যায়। হিন্দুরাজত্বে যে প্রায়ই নরবলি দেওয়া হইত, তাহা শুধু গোপীচন্দ্রের গানে নহে, বঙ্গসাহিত্যের অন্যান্য স্থানেও দৃষ্ট হয়। ১৪৭৫ খৃষ্টাব্দে রচিত রাজমালা নামক ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রায়ই এই নরবলির উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ধন্য মাণিক্যের প্রধান সেনাপতি চয়চাগ যে হুসন সাহার জনৈক পাঠান সেনাপতিকে ত্রিপুরেশ্বরীর নিকট বলি দিয়াছিলেন, তাহা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। মাণিকচন্দ্র রাজার মৃত্যু যে সকল অভিচার ক্রিয়ার ফলে ঘটয়াছিল বলিয়া কথিত আছে, রাজমালার কোন কোন স্থলে সেইরূপ অভিচার প্রক্রিয়ার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।

 প্রাচীন ব্রাহ্মণের দরবারের বেশ ভূষার একটা চিত্র এই গানে আছে, তাহার এখানে উল্লেখ না করিয়া পারিলাম না। ব্রাহ্মণ ননারূপ ধুতি পরিতেন, সেগুলির নাম—শালকিরাণি, চটক ও মটক। অবশ্য “মটক”টা আধুনিক “মটকা”র নামান্তর, এগুলি গরদের ধুতিরই প্রকার ভেদ হইবে। “শালবন পেটুকা”—কোমর বন্ধ, এবং “চল্লিশ পাগড়ি” অর্থ চল্লিশবার পাক দিয়া যে পাগড়ী বাঁধা হয়। তাঁহার এক হস্তে অঙ্গদ ও অপর হস্তে বলয় (কোড়া = কড়া) এবং কণ্ঠে স্বর্ণমালা। তিনি যাত্রাকালে জোড়া জোড়া পৈতা গলায় পরিতেন এবং কক্ষতলে একরাশ পাঁজিপুঁথি লইয়া চলিতেন।