পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মুখবন্ধ
১১

এ চিত্র বাঙ্গালী ব্রাহ্মণের হইলেও ইহা খোট্টার দেশের ব্রহ্মণ পণ্ডিতকেই বেশী মনে করাইয়া দেয়। হিন্দু-রাজত্বকালে রাজ-সভার পদ্ধতি রীতিনীতি ও বেশভূষা অনেকটা খোট্টার দেশের মতই ছিল, তবে ৪০টা বেড় দিয়া যে পাগড়ী তৈরী করিতে হয় তাহা এই উষ্ণদেশের লোকের মাথায় বেশী দিন টেকে নাই, প্রচুর ঘৃত-নবনী ও দুগ্ধপান করিয়া উদরে অতটা আঁটাআঁটি করিয়া কোমর বন্ধটা রাখাও সুবিধাজনক হয় নাই। পশ্চিমে বড় লোকের বামুনেরাও কোমরবন্ধটা ছাড়িয়া দিয়াছেন কিন্তু চল্লিশবেড় পাগড়িটি ছাড়েন নাই, তাঁহাদের স্বর্ণ বলয় ও অঙ্গদাদি পরিবার রাতিটা এখনও আছে। কেবল পৈতাটা দরবারী গোছের না হইয়া এখন অপরিহার্য্যরূপ অঙ্গীয় হইয়া উঠিয়াছে।

 মেয়েদের চুলের সৌষ্ঠবের কথা এই যুগের অনেক কাব্যেই পাওয়া যায়। ব্রহ্মদেশে ও উত্তরের পাহাড়ে দেশ যথা নেপাল, ভুটান প্রভৃতি স্থানে মেয়েদের চুল খুব ঘটা করিয়া বাঁধা হইত। এই কেশ-বন্ধন এককালে একটা উৎকৃষ্ট শিল্প ছিল। আজকালকার বঙ্গীয় চিত্রকরেরা মেয়েদের চুল-বাঁধাটার অনেক ব্যঙ্গচিত্র আঁকিয়া সংবাদপত্রে ছাপাইয়া থাকেন; কিন্তু বাঙ্গলা দেশ—এই চুল বাঁধার যে শিল্পটা হারাইয়াছে, তাহা এদেশের একটা বড় গৌরবের বিষয় ছিল। গোপীচন্দ্রের গানে চুল বাঁধিবার সেই শিল্পের প্রতি ইঙ্গিত আছে। গ্রাম্য কল্পনা এই শিল্পের বর্ণনা দিতে যাইয়া হয়ত অনেকখানি বর্বর কবিত্ব ঢুকাইয়া দিয়াছে; কিন্তু বাদ সাদ দিয়াও আমরা যে আভাষ পাই, তাহাতে মেয়েদের এই শিল্প যে একটা দর্শনীয় পদার্থ ছিল এবং ইহাতে অঙ্গনাদের কতটা ধৈর্য্যশীল মনোযোগ ও নিপুণতা প্রদর্শিত হইত, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। সন্ন্যাস খণ্ডে ২৫৩।৫৪ পৃষ্ঠাতে এই চুল বাঁধিবার কথা আছে। হীরা নটী প্রথমত চিরুণী দিয়া চুল খুব ভাল করিয়া আঁচড়াইয়া লইল; কপাল তটে—সিঁথির গোড়ায় সে সারি সারি মুক্তা পংক্তি পরিল—সেই মুক্তার সারের নীচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নয়টি তিলক রচনা করিল, তারপর—

 প্রথমতঃ “হাটে ট্যাংরা” নামক খোঁপা বাঁধিল, এই খোপার ভিতর যেন ছয় বুড়ি ছোট ছোট ছেলে খেলিতেছে—চুল বাঁধার কায়দায় এইরূপ দৃশ্য দেখা দিল; কিন্তু এ খোঁপা তাহার মনোনীত হইল না—আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সে খোঁপা ভাঙ্গিয়া ফেলিল এবং দ্বিতীয়বারে—