পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



মুখবন্ধ
১৩

“খেতু”র উপর শাসনভার ন্যস্ত করিয়া বনে যাইতে চাহিলেন, তখন খেতু ভয় পাইয়া রাজাকে বলিলেন, আপনি সহরে ঢেঁড়া দিয়া আমার প্রতিনিধিত্বের কথা প্রজাদিগকে জানাইয়া দিন―নতুবা তাহারা আমাকে মানিবে না, তদনুসারে ঢেঁড়া দেওয়া হইল, কিন্তু প্রজারা রাজার আদেশ অগ্রাহ্য করিল। “বান্দরিয়া রাইয়তের” মাথায় এই আদেশে “বজ্জর ভাঙ্গিয়া পৈল।” তাহারা এক বাক্যে বলিল “ওরে খেতুআ তোর আজাই মানি না”―(রে খেতু, তোর রাজত্ব আমরা স্বাকার করি না) “আমরা এই বার বৎসরের খাজনা মজুত রাখিব, রাজা ফিরিয়া আসিলে তাঁকে দিব, কিছুতেই তোমার শাসন মানিব না।” যখন খেতুয়া এই উক্তি শ্রবণ করিল, তখন―

“ষোল সের ছিল খেতু এক পোয়া হৈল।”

(খেতুর ওজন ষোল সের ছিল―সে এক পোয়া হইয়া গেল), অর্থাৎ সে এত বড়টা ছিল, এখন গৌরব হারাইয়া এতটুকু খানি হইয়া গেল।

 ময়মনসিংহ গীতিকাতেও প্রজাদের এই রূপ রাজ-শক্তির সঙ্গে বিরোধ মাঝে মাঝে দৃষ্ট হয়। কিন্তু ত্রিপুরার রাজমালা পাঠ করিলে এই প্রজা-শক্তি হিন্দু শাসন সময়ে যে কত বড় ছিল, তাহার ভুরি ভুরি নিদর্শন পাওয়া যায়। সেদেশে প্রজারা মাঝে মাঝে অত্যাচারী রাজার প্রাণদণ্ড পর্য্যন্ত করিয়াছে ও নূতন রাজাকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। রাজমালা একখানি বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস। কিন্তু যদিও গ্রাম্য কবিদের কল্পনাবিজড়িত হইয়া এই গানগুলি ইতিহাসের মর্য্যদা প্রাপ্ত হয় নাই, তথাপি সামাজিক ও রাজনৈতিক যে সকল আলেখ্য ইহাতে আছে―তাহাতে প্রাচীনকালের একটা প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। প্রজাশক্তি যে হিন্দুরাজত্বে নিতান্ত উপেক্ষিণীয় ছিল না, বারংবার প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য হইতে আমরা তাহার নিদর্শন পাইতেছি।

 এই যুগে যে সকল নারী চরিত্র আমরা দেখিতে পাই, তাহাদের কেহ কেহ মহিলাগণের আদর্শ। রমণীরা যে ব্রাহ্মণ্য যুগের সতীত্বের আদর্শ মানিয়া চলিতেন, এমন বোধ হয় না। ময়মনসিংহ গীতিকায় দেখা যায় তাঁহারা প্রায়ই নিজের পতি নির্ব্বাচন করিতেন, সকল সময়েই যে তাহদের বিবাহ হইত, তাহা