পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪
গোপালচন্দ্রের গান

নহে। কঙ্কের ভালবাসার জন্য লীলা প্রাণ দিয়াছিল, অথচ তাহাদের পরিণয় হয় নাই। সখিনা ও ভেলুয়া সুন্দরী পিতামাতার বিরুদ্ধে নিজের মনোনয়নকে প্রধাণ্য দিয়া অপূর্ব্ব প্রেমের তপস্যা দেখাইয়াছে। শোনাই ও কমলা নিজেরা নিজের বর পছন্দ করিয়া লইয়াছিল―তাহারা বিবাহ বাসরে মন্ত্রপুঃত মিলনের প্রতীক্ষা রাখে নাই। রাজবাড়ীর প্রথা অনুসারে অদুনা অনায়াসে খেতুকে স্বামীর পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইতে পারিত। ইহাদের সমাজে বিবাহ প্রথা একান্ত শিথিল ছিল। বিধবা বিবাহ প্রচলিত ছিল, রাজারা পর্য্যন্ত কন্যাদিগকে সময় সময় যৌতুক দিতেন, এবং দেবরেরা রাজ-বিয়োগে কি তাঁহার অনুপস্থিতিতে অনায়াসে রাণীদিগের কক্ষে যাতায়াত করিতেন। এই শিথিল সামাজিক প্রথার মধ্যে যে সকল মহিয়সী মহিলা একনিষ্ঠ প্রেমের দেবব্রত পালন করিয়াছেন, তঁহাদিগকে কি বলিব? যাহাকে সমাজ কড়াকড়ি করিয়া বিবাহ পীঠে বঁধে নাই, তাঁহারা একি অপূর্ব্ব বন্ধন স্বীকার করিয়া আত্মবলি দিয়াছেন; ইঁহারা দেখাইয়াছেন প্রেমের মত ধর্ম্ম নারীর আর নাই। স্বাধীনতা, মৈত্রী, আত্ম-নির্ভর প্রভৃতি যে কোন বড় বড় নীতি দেখাইয়া রমণীকে পুরুষ হইতে সরাইয়া লইয়া যাইতে চাও, তাহার কোনটিই রমণীকে সে গৌরব দিতে পরিবে না, যাহা প্রেম-সাধনা দ্বারা তিনি লাভ করিবেন। মলুয়া, মহুয়া, কমলা, শোনাই, মদিনা―আর তার পার্শ্বে এই অদুনা, ইঁহাদের প্রত্যেকে নারীকুলকে ধন্য করিয়াছেন। অবশ্য গোপীচন্দ্রের আর একশত স্ত্রী ছিলেন―তাঁহারা দেবর লইয়া ঘর করিয়াছিলেন―তাঁহাদিগকে স্বাধীনতা ও মৈত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়া তাঁহদের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি আপনারা সাধন করুন, কিন্তু অদুনা যেখানে আছেন তাঁহাকে সেই খানে থাকিতে দিন। এই সংসার সমুদ্রের দিশাহারা পান্থ,―পথভ্রষ্ট নাবিক যদি কোন আলোকস্তম্ভের উপর নির্ভর করিয়া পথ দেখিতে চায়, তবে অদুনা ও তাঁহার শ্রেণীরা সেইপথ দেখাইবেন। এই আলোকস্তম্ভ ভাঙ্গিলে দিশাহারা নাবিক অনির্দিষ্ট সমাজের অধ্রুব আদর্শের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রেতলোকে পৌঁছিবে। দশটা লোক কুঠার লইয়া যাইয়া তাজমহলটি ভাঙ্গিয়া আসতে পারে, কিন্তু আর একটি গড়া সহজ নহে। এই নিরক্ষর কৃষকদের জড়িত ভাষা, প্রাকৃত শব্দ বহুল বাঙ্গলাকাব্য গুলিতে,―এই সর্ব্বপ্রকার অলঙ্কার লজ্জিত ছন্দোবন্ধ হীন