পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভূমিকা

 গোপীচন্দ্রের গান স্মরণাতীত কাল হইতে রংপুর জেলায় প্রচলিত। গ্রীয়ার্সন সাহেব রাজকার্য্যোপলক্ষে রংপুরে অবস্থান-কালে উহা সংগ্রহ করেন গানের বিশেষত্বএবং ১৮৭৮ খৃঃ অব্দে এসিয়াটিক সোসাইটির জার্ণালে “মাণিকচন্দ্র রাজার গান” নাম দিয়া প্রকাশ করেন। ইংরাজী জার্ণালে দেবনাগর অক্ষরে মুদ্রিত প্রাদেশিক গান সাধারণের নিকট বিশেষ পরিচয় লাভ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” প্রণয়ন কালে শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন উহা সাধারণের গোচরীভূত করেন এবং ইহার মৌলিকত্ব ও বিশেষত্বের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। দীনেশবাবু বলেন “এই গীতির ভাব বৌদ্ধ জগতের। অনেক স্থলেই বৌদ্ধগণের উপাস্য ধর্ম্মের উল্লেখ দৃষ্ট হয়।...মাণিকচাঁদের গান সলিলে সলিল-বিন্দুর ন্যায় প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্যের সঙ্গে মিশ্রিত হইয়া এক হইয়া যায় নাই, সলিলে তৈলবিন্দুর ন্যায় স্বতন্ত্র হইয়া পড়িয়া আছে। প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য খুঁজিলেই পক্ববিম্ব, দাড়িম্ব, কদম্ব, পদ্মপলাশ, খগরাজ, তিলফুল প্রভৃতি উপমার বস্তু দেখিতে পাই। গ্রাম্যগীতগুলিও এই উপমা হইতে মুক্ত নহে,......। কিন্তু মাণিকচাঁদের গীতের রূপবর্ণনায় বৃদ্ধ ব্যাস, বাল্মীকি কি কবি কালিদাসের কোন হাত নাই। সেগুলি সংস্কৃত প্রভাব শূন্য; এবং সংস্কৃতের প্রভাবের পূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া বোধ হয়।......স্থলে স্থলে দু’ এককথায় ছবিটি সুন্দর আঁকা হইয়াছে, রূপের একখানি প্রতিবিম্ব ভাসিয়া উঠিয়াছে, অথচ দাড়িম্ব-কদম্বাত্মক রূপবর্ণনা হইতে তাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন।……স্ত্রীর বাক্যে পুত্র স্নেহময়ী মাতাকে উত্তপ্ত ৮০ মণ তৈলপূর্ণ সুবৃহৎ লৌহকটাহে নিক্ষেপ করিতেছেন এবং নয় দিন ধরিয়া অগ্নিকুণ্ডের উপর মাতৃদেহবিশিষ্ট উক্ত কটাহ সংস্থাপিত রাখিতেছেন। যে হিন্দুর গৃহে গৃহে রামায়ণী ও মহাভারতীয় নীতি, সেই হিন্দুর চক্ষে এই ঘটনা বিজাতীয়,—ইহা হিন্দু জগতের বলিয়া বোধ হয় না।” পুনশ্চ—“এই গীতে নানারূপ ভীষণ, অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক ঘটনার বর্ণনা আছে, তাহা আমরা আরব্যোপন্যাসের গল্পের ন্যায় পাঠ করিয়াছি। অনুবাদ-গ্রন্থগুলি ছাড়িয়া দিলেও কবিকঙ্কণ চণ্ডী হইতে ভারতের অন্নদামঙ্গল পর্য্যন্ত বাঙ্গালা কোন্ গ্রন্থে অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা নাই? সেই সব ঘটনা হইতে মাণিকচাঁদের গীতে বর্ণিত ঘটনা ভিন্নরূপ। সেগুলির পশ্চাতে দেবশক্তি, তাই সেগুলি হিন্দুর নিজস্ব বলিয়া পরিচিত, আর ইহার পশ্চাতে শুধু মন্ত্রশক্তি……। বৌদ্ধ জগতের এই সঙ্গীত বোধ হয় এতদিনে লুপ্ত হইয়া যাইত,