পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিন্তু প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিতে দেবদেবীর কথা সংযোজিত হওয়াতে ঐ গীতি ঈষৎ পরিমাণে হিন্দুত্বের আভা ধারণ করিয়াছে, এবং সেই হিন্দুত্বের আভাটুকুই বোধ হয় এই গানের পরমায়ু বৃদ্ধির কারণ।” গানটি বোধ হয় কোন কালেই সম্পূর্ণ বৌদ্ধজগতের ছিলনা, ইহা বহুকাল হিন্দুত্ব ও বৌদ্ধত্বের সংমিশ্রণে উৎপন্ন সম্প্রদায়-বিশেষের উপজীবিকা স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে এবং ইহাই বোধ হয় গানটির পরমায়ু বৃদ্ধির প্রধান কারণ। যে সমাজে ইহা প্রচলিত সে সমাজ এখনও সংস্কৃত ও হিন্দুত্বের গণ্ডিদ্বারা আপনাকে প্রাচীনতর সমাজ হইতে সম্যক্‌রূপে স্বতন্ত্র করিতে পাবে নাই।

গাথা সংগ্রহ এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত গান রংপুর জেলা হইতে সংগৃহীত। রংপুর জেলায় গোপীচন্দ্রের প্রাচীন গান কোথাও পুঁথিতে লিপিবদ্ধ আছে বলিয়া জানিতে পারি নাই। “যোগী” বা “জুগী” জাতীয় লোক মুখে মুখে ইহা অভ্যাস করে এবং আসরে বা ভিক্ষার সময় গোপীযন্ত্রের সাহায্যে নিজ নিজ শক্তি অনুসারে উহাদ্বারা শ্রোতার মনস্তুষ্টি জন্মাইবার চেষ্টা করে। লৌহ, বংশখণ্ড ও অলাবু দ্বারা এই গোপীযন্ত্র প্রস্তুত হয়। ভগিনী নিবেদিতা দীনেশ বাবুকে বলিয়াছিলেন, এই গোপীচন্দ্রের নাম হইতেই সম্ভবতঃ ‘গোপীযন্ত্রে’র নামকরণ হইয়াছে। বৃহৎ গানের সকল অংশ সকলে আয়ত্ত করিতে পারে না; সুতরাং গায়কের সামর্থ্য, রুচি ও প্রয়োজনানুসারে ভিন্ন ভিন্ন পালার সৃষ্টি হইয়াছে। কোথাও বা গানের কোন নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ মাত্র গীত হয়, কোথাও বা শাখা প্রশাখা কর্ত্তন করিয়া মূল কাণ্ডটি স্থির রাখিয়া যথাসম্ভব একটি সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থিত করার প্রয়াস দেখিতে পাওয়া যায়। গ্রীয়ার্সন সাহেবের সংগৃহীত গানটি শেষোক্ত শ্রেণীর, ইহা গোপীচন্দ্রের গানের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। বাবু শিবচন্দ্র শীল যে দুর্ল্লভ মল্লিক কৃত গোবিন্দচন্দ্রের গীত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাও এই গানের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। শিব বাবু, চুঁচুড়াতে কোন বৈষ্ণবীর নিকট হইতে উহার পুঁথি প্রাপ্ত হন। দুর্ল্লভ মল্লিকের গোবিন্দচন্দ্র ও “যোগী” বা “জুগী” দিগের “গোপীচক্র” অভিন্ন ব্যক্তি। এরূপ হইতে পারে যে, নামটি বাস্তবিক গোপীচন্দ্র, গোবাচাঁদ, গোবাঁচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র সকল রকমেই উচ্চারিত হইত।

 দুর্ল্লভ মল্লিকের গান পুরাতন উপকরণের সাহায্যে নূতন ভাষায় রচিত, ইহাতে উপাখ্যান ভাগও কতকটা রূপান্তরিত হইয়াছে। গ্রীয়ার্সন সাহেবের সংগৃহীত গান, প্রক্ষিপ্ত অংশ বাদ দিলে, বাস্তবিকই প্রাচীন ভিত্তির উপর গ্রথিত, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বলিয়া মনে হয় না। বাস্তবিক মূল প্রাচীন গান কিরূপ ছিল, তাহা স্থির করা এখন বড়ই কঠিন। মুখে মুখে পুরুষপরম্পরায় চলিয়া আসায় গানের ভাষা অনেকস্থলেই পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে এবং মূল গান যে অনেক স্থলে গ্রাম্য কবির হস্তযোজিত শাখাপল্লবে আবৃত হইয়া পুষ্ট কলেবরে পল্লীগ্রামের ভক্তি-পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণ করিতেছে তাহা নিঃসন্দেহ।