পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গানের ঐতিহাসিকতা দেখা যাইতেছে গোপীচন্দ্রের পিতার নাম সম্বন্ধে বঙ্গের গাথা গুলি এক মত হইলেও বঙ্গের বাহিরে ভিন্ন মত প্রচলিত। আবার তাঁহার পিতার পূর্ব্বপুরুষ সম্বন্ধে কোন দুই গাথাই একমত নহে। গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচন্দ্রের গৃহত্যাগ ও সন্ন্যাস এবং হাড়িপা গুরুর শিষ্যত্ব সম্বন্ধে কোন মত-ভেদ নাই। তিনি বাঙ্গলাদেশের রাজা এবং অদুনা পদুনার স্বামী ইহাও একরূপ স্বীকৃত। তাঁহার কাহিনী যেরূপ ভাবে বিস্তৃত তাহাতে তাঁহাকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলিয়া স্বীকার করিতেও আমরা বাধ্য। কিন্তু তাঁহার পূর্ব্ব পুরুষের নাম ও আনুষঙ্গিক ঘটনা সম্বন্ধে উপাখ্যানের বিভিন্নতা এতই অধিক, সত্যের উপর কুহেলিকার আবরণ এতই গাঢ় যে, তাঁহাকে বহুপ্রাচীন কালের লোক বলিয়া গ্রহণ করিতেই হইবে। রংপুর জেলা হইতে সংগৃহীত ও এই গ্রন্থের ১ম খণ্ডে প্রকাশিত গাথায় মাণিকচন্দ্র রাজার পূর্ব্বপুরুষের কোনও পরিচয় নাই। গ্রীয়াসন্ সাহেবের সংগৃহীত গাথায় এবং ভবানী দাসের পুঁথিতেও নাই। রংপুরের উপাখ্যান সংক্ষেপতঃ এইরূপ:—

রংপুরের উপাধ্যান বঙ্গে মাণিকচন্দ্র নামে এক “সতী” বা ধার্ম্মিক রাজা ছিলেন। তিলকচাঁদের কন্যা জ্ঞানসিদ্ধা ময়নামতী তাঁহার অন্যতমা ভার্য্যা। অন্দরমহলে “নও বুড়ী” রাণী সত্ত্বেও মাণিকচাঁদ আরও বিবাহ করিলেন এবং গৃহদ্বন্দ্ব হইতে নিস্তার পাইবার আশায় বর্ষীয়সী ময়নামতীকে পৃথক্ করিয়া ফেরুসা নগরে তাঁহার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিলেন।

 মাণিকচন্দ্রের রাজ্যে প্রজার সুখের ইয়ত্তা ছিল না। প্রজা প্রত্যেক হালে দেড় বুড়ী মাত্র খাজনা দিত এবং বিপুল সমৃদ্ধির মধ্যে দিন কাটাইত। কিন্তু এ সুখ বেশী দিন টিকিল না। দক্ষিণ হইতে এক বাঙ্গাল আসিয়া রাজার দেওয়ান হইল এবং খাজনা দেড় বুড়ী স্থলে পোনর গণ্ডা করিল। ইহাতে প্রজার দুর্দ্দশার অবধি রহিল না। চাষা খাজনার জন্য হাল গরু বিক্রয় করিল, সওদাগর নৌকা বিক্রয় করিল, ফকিরকে ঝোলা কাঁথা পর্য্যন্ত বিক্রয় করিতে হইল। “নাঙ্গল”, “জোঙ্গাল”, “ফাল”, “দুধের ছোআল” পর্য্যন্ত বিক্রীত হইতে লাগিল। তখন প্রজারা পরামর্শ করিয়া মহৎ বা প্রধানের বাড়ীতে উপস্থিত হইল এবং নদীতীরে ধর্ম্মপূজা করিয়া রাজাকে অভিশাপ দেওয়া স্থির হইল। কোন মতে প্রধান স্বয়ংই এই পরামর্শ দিলেন, কোন মতে মহাদেবের নিকট হইতে পরামর্শটী গৃহীত হইল। পরামুর্শানুযায়ী কার্য্য অনুষ্ঠিত হইলে রাজার ১৮ বৎসরের পরমায়ু ৬ মাসে পরিণত হইল, “চিত্র গোবিন্দ” দপ্তর খুলিল। বিধাতা তলবচিঠি লিখিয়া গোদাযমকে রাজার প্রাণ আনিতে নিযুক্ত করিলেন। ময়নামতী সংবাদ পাইলেন এবং এই বিপদের সময় স্বামীকে রক্ষা করিতে আসিলেন। তিনি রাজাকে জ্ঞান দিয়া অমর করিতে চাহিলেন, কিন্তু মাণিকচাঁদ স্ত্রীর নিকট জ্ঞান গহণ করিতে একেবারে অসম্মত। অগত্যা ময়নামতী যমদিগকে নানা প্রকারে নিধারণ করিতে লাগিলেন,—কখন উপঢৌকন দ্বারা, কখন তাড়নাদ্বারা। কিন্তু বিধাতার