পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৮
গোপীচন্দ্রের পাঁচালী
কায়স্থ-জাতি সম্বন্ধে নানা কথাই পাওয়া যায়। তাহার মধ্যে অল্প কএকটি এই:—‘রাজ সভায় রাজা কর্ত্তৃক নিযুক্ত কায়স্থ দ্বারা লিখিত এবং প্রাড়্ বিবাকের কর চিহ্নিত অথবা রাজমুদ্রাঙ্কিত যে লেখা তাহাই রাজসাক্ষিক।’[১] চাট, তস্কর, দুর্বৃত্ত, মহাসাহিক, বিশেষতঃ কায়স্থদিগের হস্ত হইতে রাজা পীড্যমান্ প্রজাদিগকে রক্ষা করিবেন।’[২] ১১শ শতকে রচিত বিজ্ঞানেশ্বরের যাজ্ঞবল্ক্য-টীকায় লিখিত হইয়াছে, ‘গণক ও লেখকগণই কায়স্থ। তাহারা রাজবল্লভ, অতিশয় মায়াবী ও দুর্নিবার বলিয়া তাহাদের কবল হইতে উৎপীড়িত প্রজাবৃন্দকে বিশেষভাবে রক্ষা করিবেন।’[৩]‘অপরাদিত্য কৃত যাজ্ঞবল্ক্য ভাষ্যে কায়স্থগণকে করাধিকারী (Revenue officer) বলা হইয়াছে।[৪] শূল্পাণির দীপকলিকাতে ‘রাজবল্লভ প্রযুক্ত কায়স্থ প্রভাবশালী।’[৫]
 পদ্মপুরাণ পাতাল খণ্ডে পথিবীতে ব্যবহারোপজীবী অনেক ক্ষত্রিয় আছে, অক্ষরোপজীবী কায়স্থ তাহার অন্তর্গত এইরূপ উক্ত হইয়াছে।
অশোক-অনুশাসনে ‘রাজূক’-গণ শাসন ও রাজস্ব বিভাগের শ্রেষ্ঠাধিকারী। মৌর্য্যসম্রাট্ কর্ত্তৃক ইঁহারা ‘ধর্ম্মমহামাত্র’ পদেও প্রতিষ্ঠিত হইতেন। প্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ্ ডাক্তার বুল্‌হার (Dr. Bülhler) ‘রাজূক’ শব্দে কায়স্থ বুঝিয়াছেন। আবার কেহ কেহ যাজ্ঞবল্ক্যের ‘রাষ্ট্রাধিকৃত’ (১।৩৮) এবং ‘রাজূক’ ও ‘রাজবল্লভ’ একই অর্থে প্রযুক্ত মনে করেন।
 সান্ধিবিগ্রহিক (Minister of War & Peace) পদ যে এক সময়ে কেবল কায়স্থ দ্বারা পূর্ণ হইত তাহা ‘সন্ধিবিগ্রহলেখক’ (অপরার্ক ৩।৮৬, বীরমিত্রোদয় ও কেশববৈজয়ন্তী অ° ৬), ‘সন্ধিবিগ্রহকায়স্থ’ (কথাসরিৎসাগর ৪২।৯১) প্রভৃতি পারিভাষিক সংজ্ঞাতে সুব্যক্ত।
রাজতরঙ্গিণীতে লেখক ও গণকেরা ‘দিবির’ নামে পরিচিত (৮।১৩১)। কাশ্মীর-কবি ক্ষেমেন্দ্র কৃত লোক-প্রকাশে আয়ব্যয় লেখকের পারিভাষিক আখ্যা ‘দিবির’ (৩য় প্র°); এবং তাঁহারা কায়স্থ।
 তাম্রশাসনাদিতে ‘সন্ধবিগ্রহাধিকরণাধিকৃত দিবিরপতি’, ‘জেষ্ঠকায়স্থমহামহত্তরদশ গ্রামিকাদিবিষয়ব্যবহারিক’, ‘জেষ্ঠ কায়স্থ······· প্রমুখমধিকরণ’, ‘মহাকায়স্থ’ এই প্রকার উল্লেখ বিরল নহে।
 কায়স্থের মধ্যে ‘রাজধানা’ (রাজস্থানীয়), ‘রাজু’ (রাজূক) প্রভৃতি শ্রেণী-বিভাগ আছে। এবং রাজে, বায়, চৌধুরী, রায় চৌধুরী, পাত্র, মহাপাত্র, মুন্‌শী চাকি, শিকদার প্রভৃতি পদবী যাহা এখন বংশগত হইয়া পড়িয়াছে, তাহারও ইয়ত্তা নাই।
 গুণ-কর্ম্ম-ভেদ যদি জাতি-বিভাগের মূল কারণ হয় তাহা হইলে এখন নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে যে, এক্ষণকার কায়স্থ নামধারী অক্ষরোপজীবিগণের পূর্ব্বপুরুষেরা সামান্য লেখকের কর্ম্ম হইতে রাজপ্রতিনিধিত্ব পর্য্যন্ত করিয়া গিয়াছেন।
 ২২৫ বৎসরের উপর কাশ্মীর-রাজ্য কায়স্থ রাজগণের শাসন কর্ত্তৃত্বে ছিল। আবুল ফজল বলেন, সুবে বাঙ্গালার ভূস্বামী প্রায় সকলেই কায়স্থ। মুসলমান আগমনের বহু পূর্ব্ব হইতে এই প্রদেশ বিভিন্ন কায়স্থরাজবংশের শাসনাধীনে ছিল।
 কায়স্থের বিদ্যা চর্চ্চা লোক-প্রসিদ্ধ। তাঁহাদের ‘মহাসিদ্ধাচার্য্য,’ উপাধ্যায়’, ‘মহামহোপাধ্যায়’ প্রভৃতি উপাধিও ছিল।
  1. ‘রাজাধিকরণে তন্নিযুক্তকায়স্থকৃতং তদাধ্যক্ষকরচিহ্নিতং রাজসাক্ষিকম্।’ বিষ্ণুস্মৃতি ৭।২।
  2. ‘চাটতস্করদুর্বৃত্তমহাসাহসিকাদিভিঃ। পীড্যমানাঃ প্রজা রক্ষেৎ কায়স্থৈশ্চ বিশেষতঃ।’ যাজ্ঞবল্ক্য ১।৩৩।
  3. ‘কায়স্থা গণকা লেখকাশ্চ তৈঃ পীড্যমানাঃ বিশেষতো রক্ষেৎ তেষাং রাজবল্লভতয়াতিমায়াবিত্বাচ্চ দুর্নিবারতাৎ। মিতাক্ষরা
  4. কায়স্থাঃ করাধিকৃতাঃ অপরাক।
  5. ‘কায়স্থৈঃ রাজসম্বন্ধাৎ প্রভবিষ্ণুভিঃ।