পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২

প্রত্যর্পণ করিলেন। হীরা নটীকে শাস্তি দেওয়া হইল। তাহাকে শাপ দিয়া “যোড় বগদুল” করিয়া ও তাহার ধন খাপড়ায় পরিণত করিয়া হাড়িসিদ্ধা চলিয়া আসিলেন।

 এইবার গোপীচন্দ্রের রাজধানীতে প্রত্যাগমন। পথে রাজার গুরুর নিকট জ্ঞান শিক্ষা হইল। জ্ঞানের পরীক্ষাও হইল। রাজা অনেক করিয়া জিজ্ঞাসাবাদের পর ছদ্মবেশে বাড়ীতে ফিরিলেন। তাঁহার উপর কুকুর লেলাইয়া দেওয়া হইল, কিন্তু কুকুরেরা তাঁহার পায়ে পড়িয়া কান্দিতে লাগিল। বান্দীগণ ভিক্ষা দিতে আসিল, কিন্তু তিনি তাহাদের হস্তে ভিক্ষা লইলেন না। অদুনা ও পদুনা ভিক্ষা দিতে আসিলেন, কিন্তু রাজা স্ত্রীলোকের হস্তে ভিক্ষা লইবেন না, তাহাদের “মাথার ছত্তর” অর্থাৎ স্বামীকে চাই। অবশেষে ছদ্মবেশী রাজা স্বীয় মৃত্যুকাহিনী প্রচার করিলে রাণীরা আত্মহত্যা করিতে উদ্যত হইলেন। তখন পরিচয় হইল। রাজা আবার ফেরুসা নগরে সোনার ভোমরা রূপে গিয়া মাতার চরকা উড়াইয়া দিয়া নিজের “জ্ঞান” দেখাইলেন। মাতাপুত্রে মিলন হইল। গোপীচন্দ্রের রাজধানীতে আনন্দস্রোত বহিতে লাগিল, হস্তী রাজাকে সিংহাসনে বসাইল, ময়নার হুঙ্কারে দেবগণ পর্য্যন্ত আসিয়া উৎসবে যোগ দিলেন। প্রজার খাজনা আবার দেড় বুড়ী হইল, তাহাদের সুখের দিন আবার ফিরিয়া আসিল।

উপাখ্যানে পার্থক্য রংপুর অঞ্চলে প্রচলিত এই উপাখ্যানের সহিত এই গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত উপাখ্যানের মূল বিষয়ে ঐক্য থাকিলেও আনুষঙ্গিক বিবরণগত পার্থক্য অনেক। গোপীচন্দ্রের জন্মে মাণিকচন্দ্রের কর্ত্তৃত্বের অভাব সুকুর মামুদের গ্রন্থেও আছে। কিন্তু মাণিকচন্দ্রের মৃত্যুর পর গোপীচন্দ্রের গর্ব্ভে অবস্থান কেবল এই রংপুরের গীতেই দেখিতে পাওয়া যায়। শুকুর মামুদের মতে মাণিকচন্দ্রই গোপীচন্দ্রকে বিবাহ করাইলেন ও রাজপাটে বসাইলেন, ময়নামতী বা “মনী” তখন ধ্যানে। রংপুরের গাথায় গোপীচন্দ্রের রাণীদিগের মধ্যে কেবল হরিশ্চন্দ্র রাজার কন্যা অদুনা ও পদুনারই নামোল্লেখ আছে। ভবানীদাস অদুনা, পদুনা, রতনমালা ও কাঞ্চনমালা রাণীর নাম করিয়াছেন। সুকুর মামুদ পূর্ব্বদেশের মহেশচন্দ্র রাজার কন্যা চন্দনা, উত্তর দেশের নেহালচন্দ্র রাজার কন্যা ফন্দনা এবং পশ্চিমদেশের হরিশ্চন্দ্র রাজার কন্যা অদুনা ও পদুনার সহিত রাজার বিবাহ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। ভবানীদাসের গানেও মাণিকচন্দ্র রাজার সময় প্রজার সমৃদ্ধির বিবরণ দেখিতে পাই। তাঁহার মতে প্রজার করবৃদ্ধি মাণিকচন্দ্রের সময়ে নয়, গোপীচন্দ্রের প্রথম রাজত্বকালে। রংপুরের গানে ময়নামতীর পরীক্ষার পালা ও সন্ন্যাস গমনকালে পথিমধ্যে রাজার লাঞ্ছনা খুব বিস্তৃত রূপে বর্ণিত হইয়াছে। সুকুর মামুদের গ্রন্থে পরীক্ষার কথা আদপেই নাই; হাড়িফাকে বিষপ্রয়োগের কথা আছে। ভবানীদাস জতুগৃহে অগ্নিপরীক্ষা, সমুদ্র মধ্যে ছালায় বান্ধিয়া নিক্ষেপ ও ক্ষুরের ধারনির উপর ময়নামতীর হাঁটার কথা বলিয়াছেন।