পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩

অধিকন্তু রাণীদিগের হস্তে ময়নামতীকে বিষ খাওয়াইয়া ও ঘোড়ার আস্তাবলে প্রোথিত করিয়া আরও দুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন। বিদায়কালীন রাণীদিগের করুণরসাত্মক পালা সকল গ্রন্থেই আছে। কিন্তু ময়নামতীর প্রতি নৃশংস ব্যবহার বোধ হয় ভবানীদাসের গ্রন্থেই অধিক। রংপুরের গানে ও মহারাষ্ট্রীয় গ্রন্থে রাজার সন্ন্যাস হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের পর পুনঃ রাজত্বের উল্লেখ দেখিতে পাই। সুকুর মামুদের গ্রন্থে তাহার উল্লেখ নাই। ভবানীদাসের গ্রন্থে তাহার আভাষ মাত্র আছে। দুর্ল্লভ মল্লিকের গ্রন্থে পাই, দ্বাদশবৎসর অন্তে রাজার দেশান্তর হইতে ফিরিবার পর হাড়িপা ও অন্যান্য যোগীদিগের উপর অত্যাচার এবং তৎপরে কানুপার সহিত সম্মিলন ও হাড়িপার মৃত্তিকাভ্যন্তর হইতে উঠিবার পর পুনরায় সন্ন্যাস।

 রংপুরের গানে ও ভবানীদাসের গ্রন্থে মূল বিষয়ে অনেক ঐক্য দেখিতে পাওয়া যায়। অনেক স্থলে ভাবেরও এত মিল যে, হয় একটী হইতে অপরটীর ভাব গৃহীত হইয়াছে অথবা উভয়েই কোন সাধারণ প্রাচীন গাথার নিকট ঋণী। ভাষায় ও যে মিলের সম্পূর্ণ অভাব একথা বলা যায় না। হাড়িসিদ্ধাকে গোপীচন্দ্রের মাটীর তলে পুঁতিয়া ফেলিবার কথা তিব্বতীয় গ্রন্থে, মহারাষ্ট্রীয় প্রবাদে, দুর্ল্লভ মল্লিকের গীতে ও সুকুর মামুদের গাথায় দেখিতে পাওয়া যায়। রংপুরের গাথায় ও ভবানীদাসের গ্রন্থে ইহার উল্লেখ নাই। হাড়িপার অদ্ভুত কর্ম্ম অবশ্য সকল গাথাতেই লিপিবদ্ধ; কোথাও বিস্তৃত ভাবে, কোথাও সংক্ষেপে। কোন কোন স্থানে এ বিষয়ে এক গাথার সহিত অন্য গাথার মিল আছে, কোথাও বা নাই। রাজার পারিষদবর্গের নামেও স্থানে স্থানে ঐক্য, স্থানে স্থানে অনৈক্য দৃষ্ট হয়। কিন্তু প্রধান পার্থক্য ঘটনাবলীর ভৌগোলিক সংস্থানে। রংপুরের জুগী কবিগণ ঘটনাগুলি নিজ নিজ বাড়ীর নিকট নির্দ্দেশ করেন। ত্রিপুরা জেলার কবি ভবানীদাসের মতে প্রধান ঘটনা গুলি সবই ত্রিপুরা অঞ্চলে। সুকুর মামুদের যে মুদ্রিত গ্রন্থ আমাদের হস্তগত হইয়াছে তাহাতে কবির বাসস্থানের কোন পরিচয় নাই; কিন্তু তাঁহার গ্রন্থের যে হস্তলিখিত পুঁথি ঢাকা মিউজিয়মের কিওরেটর বাবু নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয়ের নিকট আছে তদনুসারে কবির বাসস্থান সিন্দুরকুসুমী গ্রামে। এই পুঁথি দিনাজপুর জেলায় সংগৃহীত। সিন্দুর কুসুমী গ্রাম রাজসাহী জেলার রামপুর বোয়ালিয়া হইতে প্রায় ৬ মাইল উত্তরে বা উত্তর-পূর্ব্বে। ইহাতেও কিন্তু ঘটনা-স্থান প্রধানতঃ ত্রিপুরা জেলায়।

গানে জ্ঞাতব্য বিষয় ১৩১৫ সনে (সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য) রংপুরে সংগৃহীত গান সম্বন্ধে আমি লিখিয়াছিলাম, “ইহা প্রহসন নহে; রামায়ণ ও মহাভারত খাঁটি হিন্দুর নিকট যতদূর সত্য, ময়নামতীর গাথাও যোগীদিগের এবং তাহাদের বহুসংখ্যক শ্রোতার নিকট ততদূর সত্য। বঙ্গভাষার সেবকের নিকট ইহাতে বিবিধ আবর্জ্জনার