পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯

গোপীচন্দ্রের আনুমানিক সময়প্রভাব নিম্নবঙ্গে কতদূর বিস্তৃত ছিল বলা যায় না। এই অন্ধকার যুগের কোন সময়ে মাণিকচন্দ্র ও গোপীচন্দ্রের বঙ্গদেশে রাজত্ব করা অসম্ভব নহে, তবে তাহার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নাই। পক্ষান্তরে রাজেন্দ্র চোলের অভিযানকালে যে ঝড়বৃষ্টিপূর্ণ ‘বঙ্গাল’ দেশে গোবিন্দচন্দ্র নামে এক রাজা রাজত্ব করিতেন তাহা নিঃসন্দেহ। ইণ্ডিয়া অফিসের পুস্তকতালিকায় (Catalogue no 2739 m.m. 138le) এক গোবিন্দচন্দ্রের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। শব্দপ্রদীপ-রচয়িতা সুরেশ্বর স্বীয় পরিচয়ে লিখিয়াছেন যে, তিনি ভীমপাল নৃপতির বাজবৈদ্য, তাঁহার পিতা ভদ্রেশ্বর রাজা রামপালের প্রধান চিকিৎসক এবং ভদ্রেশ্বরের পিতামহ দেবগণ গোবিন্দচন্দ্রের রাজসভায় “বৈদ্যগণাগ্রণী” ছিলেন। শব্দপ্রদীপের রাজা গোবিন্দচন্দ্র ও রাজেন্দ্রচোলের গোবিন্দচন্দ্র সম্ভবতঃ অভিন্ন। এই হিসাবে খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রের আবির্ভাব ধরিয়া লইতে পারা যায়। তিনি আরও প্রাচীন কালের লোক হইতে পারেন, কিন্তু পরবর্ত্তীকালের লোক হওয়া সম্ভব নহে।

হরিশ্চন্দ্র, অদুনা ও পদুনা গোপীচন্দ্রের শ্বশুর হরিশ্চন্দ্র বা হরিশ্চন্দ্র রাজা কোন্ স্থানের লোক ছিলেন, তাহাও জানিবার উপায় নাই। দুর্ল্লভ মল্লিক ইঁহার বাসস্থান কাঞ্চনানগর বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন এবং অদুনার মুখ হইতে নগরের গড় ও স্বর্ণহীরকাদি ঐশ্বর্য্যের বর্ণনা বাহির করিয়া গোবিন্দচন্দ্রকে (বা পাঠককে) চমৎকৃত করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। মহারাষ্ট্রীয় গাথায় কিন্তু গোপীচন্দ্রের নিজের রাজধানী কাঞ্চননগর। হয়ত কাঞ্চননগর বা কাঞ্চনা নগরের উল্লেখ প্রাচীন সুবিখ্যাত কর্ণসুবর্ণের স্মৃতির পরিচয় মাত্র। ইহার কোন ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলিয়া মনে হয় না। রংপুর জেলায় ময়নামতীর কোটের অদূরে (ধর্ম্মপাল হইতে ৭।৮ মাইল ব্যবধানে) হরিশ্চন্দ্র পাট বিদ্যমান। গ্রামের নাম এবং স্থানীয় প্রবাদ ও ধ্বংসাবশেষ হরিশ্চন্দ্রের অতীত মহিমার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। দুইটী বৃহৎ মৃত্তিকাস্তূপ এখনও পার্শ্ববর্ত্তী লোকের বিস্ময়োৎপাদন করিতেছে। একটীর মধ্যে রাজার সমাধি ছিল বলিয়া ডাঃ গ্রীয়ার্সন উল্লেখ করিয়াছেন। এই স্তূপ এখন বিপর্য্যস্ত ও ইহার উপকরণ স্থানান্তরিত, কিন্তু এক সুবৃহৎ প্রস্তর-খণ্ড এখনও বিস্তৃত সমতল ক্ষেত্রের মধ্যে আপনার একমাত্র অবস্থান জনিত গৌরব উপভোগ করিতেছে। এই গ্রামে গোপীচন্দ্রের সহিত অদুনা ও পদুনার প্রথম-প্রণয় সম্মিলন হইয়াছিল কিনা তাহা বিবেচনার বিষয়। ঢাকা জেলার সাভার গ্রামে হরিশ্চন্দ্র নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি তাঁহার পুত্র মহেন্দ্রের যে সংস্কৃত লিপি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে তাঁহার সময়ের সহিত গোপীচন্দ্রের সময়ের সামঞ্জস্য রাখা কঠিন হইয়া পড়ে।[১]
  1. Dacca Review. Sep. and October 1920. মহেন্দ্রের লিপির সময় মীনাঙ্কাদ্রি লিখিত হইয়াছে।