পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫

আর কুস্প ছিড়া মা বনমালা গাঁথিল।
গলাতে পরিল বুড়িমা গজমতি হার।
কমরে কিঙ্কিনি পইল মা চরনে পাউটি।
দশ নেঙ্গুল পইল মা আর কানে দুল।
নাট নটন কর মা দেখিতে মধুর।
ভক্তের হাতের জলকুস্প নিয়া মা সর্গের দেবতা সর্গে চলি জাবো॥

 স্থানে স্থানে পদটীকা সন্নিবেশিত হইয়াছে, কিন্তু সম্পূর্ণ মন্ত্রটী বোঝা আমাদের সাধ্যায়ত্ত নহে। মন্ত্রের শব্দ পবিত্র বলিয়া তাহা প্রায়ই পরিবর্ত্তিত হয় না, পুরোহিতের মুখে বিকৃত হয় মাত্র। এই বিকৃতিতে মন্ত্রের মাহাত্ম্য বাড়ে বই কমে না। এখানে বলা উচিত রংপুর জেলায় বুড়ীপূজা বিস্তৃতরূপে প্রচলিত। ময়নাবুড়ী ও বুড়ী পূজার মন্ত্র অভিন্ন।

 বুড়ীপূজায় কলায় যে সিন্দুর দেওয়া হয় তাহার মন্ত্রটী এইরূপ—

কপালনি চণ্ডি ভৈরো ভবানি অলুর নাশিনি।
সিঙ্গ বাহিনি আখণ্ড কলাতে সেন্দুর ফোটা।
নিলক্‌খে চণ্ডি বুড়ি গ্রামদেবতা দেবতায় নমঃ॥

নাথধর্ম্ম যে নাথধর্ম্মের সহিত এই গাথাগুলি জড়িত তাহা এক সময়ে এ দেশে বেশ প্রভাবশালী ছিল। বর্ত্তমান কালের যুগীদিগের ন্যায় নাথপন্থিগণ চিরকালই সামাজিক জগতের এত নিম্নস্তরে ছিল না। বঙ্গদেশ নাথধর্ম্মের একটী প্রধান স্থান ছিল। মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁহার “বৌদ্ধগান ও দোহা”য় মীননাথের রচিত বাঙ্গালা করিতা উদ্ধৃত করিয়াছেন। প্রাচীন নাথেরা কেহ বৌদ্ধধর্ম্ম হইতে, কেহ হিন্দু ধর্ম্ম হইতে আসিয়া নাথপন্থী হইয়া পড়েন; গোরক্ষনাথ বৌদ্ধধর্ম্ম হইতে আসেন। তারনাথের মতে তাঁহার পূর্ব্ব নাম অনঙ্গবজ্র, কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয় বলেন প্রকৃত নাম রমণবজ্র। যিনি যেখান হইতেই আসুন, নাথদিগের প্রবর্ত্তিত পন্থায় সর্ব্বত্রই হঠযোগের আধিপত্য লক্ষিত হয়, তাঁহাদের ধর্ম্মমত হিন্দু এবং বৌদ্ধ মতের সংমিশ্রণে উৎপন্ন; তান্ত্রিকতা ইহাতে খুবই প্রবল। এই গ্রন্থেও অনেক স্থলে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে হিন্দুর দেবগণকে সিদ্ধাদিগের নীচে আসন দেওয়া হইয়াছে। স্থানে স্থানে সিদ্ধাদিগের হস্তে দেবতাদিগের অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করার কথাও আছে—ময়নামতীর হস্তে শিব লাঞ্ছিত। যুগীদিগের পূর্ব্বপ্রভাব এখন কিছুই নাই। ইহারা ক্রমশঃ খাঁটি হিন্দুত্বের মধ্যে বেশী রকম আসিয়া পড়িয়াছে এবং গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বস্ত্রবয়ন, চুণবিক্রয় ও অন্যান্য ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে।