পাতা:গোপীচন্দ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গোপীচন্দ্রের গান

 হিন্দু এবং মুসলমান কবি ও শ্রোতারা প্রায় সাত শত বৎসর যাবৎ এই গোপীচন্দ্রের গান বাঙ্গলা দেশে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন। এই গানের প্রভাব এক সময় এত বেশী ছিল যে আসমুদ্র হিমাচল পর্য্যন্ত এই মহাপ্রদেশের লোকবৃন্দ বঙ্গের রাজা গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস কাহিনী শুনিয়া করুণ রসে বিগলিত হইতেন। ভাগলপুর, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি প্রদেশগুলিতে এখনও গোপীচন্দ্রের গান শোনা যায়;—এখনও মহারাষ্ট্র রঙ্গমঞ্চে গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস অভিনিত হয়,—এখনও উষ্ণীশধারী, গোপীযন্ত্র হস্তে শত শত উত্তর পশ্চিমের গায়ক “গোপীচন্দ্রের গান” গাইয়া জীবিকা অর্জ্জন করে। সেদিনও রাজ-চিত্রকর রবিবর্ম্মা “গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসের” চিত্র আঁকিয়া বঙ্গাধিপকে ভারতবর্ষের সর্ব্বত্র পুনরায় সুপরিচিত করিয়া দিয়াছেন। উড়িষ্যা হইতে ময়নামতী গানের বিস্তৃত পুথি পাওয়া গিয়াছে। বঙ্গাধিপ গোবিন্দচন্দ্র সামান্য লোক ছিলেন না, যদিও গ্রাম্য কবিরা তাঁহাদের সংকীর্ণ ও অমার্জ্জিত কল্পনা দ্বারা ইহার অতুল ঐশ্বর্য্য আয়ত্ব করিতে না পারিয়া ইঁহাকে কেহ বা “বোল দণ্ডের” রাজা করিয়াছেন, কেহবা ইঁহার পৈত্রিক “সরুয়া নলের বেড়ার” প্রশংসা করিয়াছেন তথাপি ঐতিহাসিক গোবিন্দ চন্দ্র বা গোপীচন্দ্র যে ভারতবর্ষের একজন নৃপতি-শিরোমণি ছিলেন, তৎসম্বন্ধে সন্দেহ নাই। ত্রিপুরার ইতিহাস রাজমালা লেখক রাজা-ধন্যমাণিক্যের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায় গৌড়াধিপ হুসেন সাহা বহুবার তাঁহার পাঠান সেনানায়কগণকে ত্রিপুর বিজয়ের অভিযানে পাঠাইয়াও ঐ রাজ্য দখল করিতে পারেন নাই, বারংবার পাঠানেরা ধন্যমাণিক্যের সেনাপতি চয়চাগের হস্তে পরাস্ত হইয়াছিলেন, এমন কি এক জন প্রধান পাঠান সেনাপতিকে চয়চাগ কালী মন্দিরে বলি দিয়া গৌরেশ্বরকে বিপর্য্যস্ত করিয়া ছিলেন। কিন্তু ছুটি খাঁ নামক পাঠান সেনাপতির স্তাবক-কবি শ্রীকরণ নন্দী তাহার মুরব্বির সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন:―

“ত্রিপুর নৃপতি যার ডরে এড়ে দেশ।
পর্ব্বত গহ্বরে গিয়া করিল প্রবেশ॥”

সর্ব্ব দেশের ইতিহাসেই জয়-পরাজয় লইয়া দুই পক্ষের এইরূপ সত্যবিরোধী বর্ণনা পাওয়া যায়। বঙ্গদেশ হইতে সুদূরে যাইয়া গোবিন্দ