পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

সেদিন দুই বন্ধুর মধ্যে আর কোনো কথা হইল না, কেবল জগতের উপর সন্ধ্যার অন্ধকার পর্দা পড়িলে প্রণয়ীদের মধ্যে যখন মনের পর্দা উঠিয়া যায় সেই সময় বিনয় ছাতের উপর বসিয়া সিধা আকাশের দিকে তাকাইয়া বলিল, “দেখো, গোরা, একটা কথা আমি তোমাকে বলতে চাই। আমার মনে হয় আমাদের স্বদেশপ্রেমের মধ্যে একটা গুরুতর অসম্পূর্ণতা আছে। আমরা ভারতবর্ষকে আধখানা করে দেখি।”

 গোরা। কেন বলো দেখি?

 বিনয়। আমরা ভারতবর্ষকে কেবল পুরুষের দেশ বলেই দেখি, মেয়েদের একেবারেই দেখি নে।

 গোরা। তুমি ইংরেজদের মতো মেয়েদের বুঝি ঘরে বাইরে, জলে স্থলে শূন্যে, আহারে আমোদে কর্মে, সর্বত্রই দেখতে চাও? তাতে ফল হবে এই যে, পুরুষের চেয়ে মেয়েকেই বেশি করে দেখতে থাকবে— তাতেও দৃষ্টির সামঞ্জস্য নষ্ট হবে।

 বিনয়। না না, তুমি আমার কথাটাকে ওরকম করে উড়িয়ে দিলে চলবে না। ইংরেজের মতো করে দেখব কি না-দেখব সে কথা কেন তুলছ! আমি বলছি এটা সত্য যে, স্বদেশের মধ্যে মেয়েদের অংশকে আমাদের চিন্তার মধ্যে আমরা যথাপরিমাণে আনি নে। তোমার কথাই আমি বলতে পারি, তুমি মেয়েদের সম্বন্ধে এক মূহূর্তও ভাব না— দেশকে তুমি যেন নারীহীন করে জান— সেরকম জানা কখনোই সত্য জানা নয়।

 গোরা। আমি যখন আমার মাকে দেখেছি, মাকে জেনেছি, তখন আমার দেশের সমস্ত স্ত্রীলোককে সেই এক জায়গায় দেখেছি এবং জেনেছি।

 বিনয়। ওটা তুমি নিজেকে ভোলাবার জন্যে একটা সাজিয়ে কথা বললে মাত্র। ঘরের কাজের মধ্যে ঘরের লোকে ঘরের মেয়েদের অতিপরিচিত ভাবে দেখলে তাতে যথার্থ দেখাই হয় না। নিজেদের গার্হস্থ্য প্রয়োজনের বাইরে আমরা দেশের মেয়েদের যদি দেখতে পেতুম তা হলে আমাদের স্বদেশের সৌন্দর্য এবং সম্পূর্ণতাকে আমরা দেখতুম, দেশের এমন একটি

১৩৪