পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 শেষকালে একদিন নীলকান্তকে গোপন করিয়া একখানা কাগজে সহি দিলাম। তাহাতে কী যে লেখা ছিল তাহা ভালো করিয়া বুঝিয়া দেখি নাই। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমার সই করিতে ভয় কী—আমি এমন কী রাখিতে চাই যাহা আর-কেহ ঠকাইয়া লইলে সহ্য হইবে না! সবই তো আমার শ্বশুরের, তাঁহার ছেলেরা পাইবে, পাক।

 লেখাপড়া রেজেস্‌টি হইয়া গেলে আমি নীলকান্তকে ডাকিয়া কহিলাম—নীলুদাদা, রাগ করিয়ো না, আমার যাহা-কিছু ছিল লিখিয়া পড়িয়া দিয়াছি। আমার কিছুতেই প্রয়োজন নাই।

 নীলকান্ত অস্থির হইয়া উঠিয়া কহিল—অ্যাঁ, করিয়াছ কী!

 যখন দলিলের খসড়া পড়িয়া দেখিল সত্যই আমি আমার সমস্ত স্বত্ব ত্যাগ করিয়াছি তখন নীলকান্তের ক্রোধের সীমা রহিল না। তাহার প্রভুর মৃত্যুর পর হইতে আমার ঐ “হক' বাঁচানোই তাহার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল। তাহার সমস্ত বুদ্ধি সমস্ত শক্তি ইহাতেই অবিশ্রাম নিযুক্ত ছিল। এ লইয়া মামল্‌-মকদ্দমা, উকিলবাড়ি-হাঁটাহাঁটি, আইন খুঁজিয়া বাহির করা, ইহাতেই সে সুখ পাইয়াছে—এমন-কি, তাহার নিজের ঘরের কাজ দেখিবারও সময় ছিল না। সেই “হক' যখন নির্বোধ মেয়েমানুষের কলমের এক আঁচড়েই উড়িয়া গেল তখন নীলকান্তকে শান্ত করা অসম্ভব হইয়া উঠিল।

 সে কহিল—যাক, এখানকার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্বন্ধ চুকিল, আমি চলিলাম।

 অবশেষে নীলুদাদা এমন করিয়া রাগ করিয়া আমার কাছ হইতে বিদায় হইয়া যাইবে শ্বশুরবাড়ির ভাগ্যে এই কি আমার শেষ লিখন ছিল। আমি তাহাকে অনেক মিনতি করিয়া ডাকিয়া বলিলাম—দাদা, আমার উপর রাগ করিয়ো না। আমার কিছু জমানো টাকা আছে তাহা হইতে তোমাকে এই পাঁচশো টাকা দিতেছি—তোমার ছেলের বউ যেদিন আসিবে সেইদিন আমার আশীর্বাদ জানাইয়া এই টাকা হইতে তাহার গহনা গড়াইয়া দিয়ো।

২৯৬