পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভেবে পাচ্ছি নে কী করলে ওর ঠিক— তুমি কি বল বিনয়কে আমাদের পরিবারে যাতায়াত করতে দিয়ে ললিতার কোনো অনিষ্ট করা হয়েছে?”

 সুচরিতা কহিল, “বাবা, তুমি তো জান বিনয়বাবুর মধ্যে কোনো দোষ নেই— তাঁর নির্মল স্বভাব— তাঁর মতো স্বভাবতই ভদ্রলোক খুব অল্পই দেখা যায়।”

 পরেশবাবু যেন একটা কোন্‌ নূতন তত্ত্ব লাভ করিলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা বলেছ, রাধে, ঠিক কথা বলেছ। তিনি ভালো লোক কিনা এইটেই দেখবার বিষয়— অন্তর্যামী ঈশ্বরও তাই দেখেন। বিনয় যে ভালো লোক, সেখানে যে আমার ভুল হয় নি, সেজন্যে আমি তাঁকে বার বার প্রণাম করি।”

 একটা জাল কাটিয়া গেল— পরেশবাবু যেন বাঁচিয়া গেলেন। পরেশবাবু তাঁহার দেবতার কাছে অন্যায় করেন নাই। ঈশ্বর যে তুলাদণ্ডে মানুষকে ওজন করেন সেই নিত্যধর্মের তুলাকেই তিনি মানিয়াছেন— তাহার মধ্যে তিনি নিজের সমাজের তৈরি কোনো কৃত্রিম বাটখারা মিশান নাই বলিয়া তাঁহার মনে আর কোনো গ্লানি রহিল না। এই অত্যন্ত সহজ কথাটা এতক্ষণ তিনি না বুঝিয়া কেন এমন পীড়া অনুভব করিতেছিলেন বলিয়া তাঁহার আশ্চর্য বোধ হইল। সুচরিতার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, “তোমার কাছে আমার আজ একটা শিক্ষা হল মা!"

 সুচরিতা তৎক্ষণাৎ তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া কহিল, “না না, কী বল বাবা!"

 পরেশবাবু কহিলেন, “সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিয়ে দেয়— মানুষ ব্রাহ্ম কি হিন্দু এই সমাজ-গড়া কথাটাকেই বিশ্বসত্যের চেয়ে বড়ো করে তুলে একটা পাক তৈরি করে— এতক্ষণ মিথ্যা তাতে ঘুরে মরছিলুম।”

 একটু চুপ করিয়া থাকিয়া পরেশ কহিলেন, “ললিতা তার মেয়ে-ইস্কুলের সংকল্প কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। সে এ সম্বন্ধে বিনয়ের সাহায্য নেবার

৩৭০