পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যে কোনোমতেই ব্রাহ্মসমাজের বাহিরে থাকিতে পারে না, ইহারই প্রমাণ পাইয়া তাহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল। সে কহিল, “কিন্তু পরশু রবিবারের মধ্যেই কি হয়ে উঠবে? অনেকেই খবর জানতে পারবে না।”

 সুধীরের ইচ্ছা, বিনয়ের এই দীক্ষাকে একটা দৃষ্টান্তের মতো সর্বসাধারণের সম্মুখে ঘোষণা করা হয়।

 বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, এই রবিবারেই হয়ে যাবে। সুধীর, তুমি দৌড়ে যাও, পানুবাবুকে শীঘ্র ডেকে আনো।”

 যে হতভাগ্যের দৃষ্টান্তের দ্বারা সুধীর ব্রাহ্মসমাজকে অজেয়শক্তিশালী বলিয়া সর্বত্র প্রচার করিবার কল্পনায় উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিল তাহার চিত্ত তখন সংকুচিত হইয়া একেবারে বিন্দুবৎ হইয়া আসিয়াছিল। যে জিনিসটা মনে মনে কেবল তর্কে যুক্তিতে বিশেষ কিছুই নহে তাহারই বাহ্য চেহারাটা দেখিয়া বিনয় ব্যাকুল হইয়া পড়িল।

 পানুবাবুকে ডাক পড়িতেই বিনয় উঠিয়া পড়িল। বরদাসুন্দরী কহিলেন, “একটু বোসো, পানুবাবু এখনই আসবেন, দেরি হবে না।”

 বিনয় কহিল, “না। আমাকে মাপ করবেন।”

 সে এই বেষ্টন হইতে দূরে সরিয়া গিয়া ফাঁকায় সকল কথা ভালো করিয়া চিন্তা করিবার অবসর পাইলে বাঁচে।

 বিনয় উঠিতেই পরেশবাবু উঠিলেন এবং তাহার কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিলেন, “বিনয়, তাড়াতাড়ি কিছু কোরো না-শান্ত হয়ে স্থির হয়ে সকল কথা চিন্তা করে দেখো। নিজের মন সম্পূর্ণ না বুঝে জীবনের এত বড়ো একটা ব্যাপারে প্রবৃত্ত হোয়ো না।”

 বরদাসুন্দরী তাঁহার স্বামীর প্রতি মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “গোড়ায় কেউ ভেবেচিন্তে কাজ করে না, অনর্থ বাধিয়ে বসে, তার পর যখন একেবারে দম আটকে আসে তখন বলেন, ‘বসে বসে ভাবো।’ তোমরস্থির হয়ে বসে ভাবতে পারো, কিন্তু আমাদের যে প্রাণ বেরিয়ে গেল।”

৪৩১