পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বিনয় হাসিয়া কহিল, “ভাই গোরা, ঠিক এই-সব কথা আমিও এতদিন এমনি করেই বলে এসেছি- আজ আবার আমাকেও সে কথা শুনতে হবে তা কে জানত। কথা বানিয়ে বলবার শান্তি আজ আমাকে ভোগ করতে হবে, সে আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তর্ক করে কোনো লাভ নেই। কেননা, একটা কথা আমি আজ খুব নিকটের থেকে দেখতে পেয়েছি, সেটি পূর্বে দেখি নি; আজ বুঝেছি, মানুষের জীবনের গতি মহানদীর মতো, সে আপনার বেগে অভাবনীয় রূপে এমন নূতন নূতন দিকে পথ করে নেয় যে দিকে পূর্বে তার স্রোত ছিল না- এই তার গতির বৈচিত্র্য, তার অভাবনীয় পরিণতিই বিধাতার অভিপ্রায়—সে কাটাখাল নয়, তাকে বাঁধা পথে রাখা চলবে না। নিজের মধ্যেই যখন এ কথাটা একেবারে প্রত্যক্ষ হয়েছে তখন কোনো সাজানো কথায় আর আমাকে কোনোদিন ভোলাতে পারবে না।”

 গোরা কহিল, “পতঙ্গ যখন বহ্নির মুখে পড়তে চলে সেও তখন তোমার মতো ঠিক ওইরকম তর্কই করে, অতএব তোমাকে আমিও আজ বোঝাবার কোনো বৃথা চেষ্টা করব না।”

 বিনয় চৌকি হইতে উঠিয়া কহিল, “সেই ভালো- তবে চললুম— একবার মার সঙ্গে দেখা করে আসি।”

 বিনয় চলিয়া গেল, মহিম ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। পান চিবাইতে চিবাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুবিধা হল না বুঝি? হবেও না। কতদিন থেকে বলে আসছি, সাবধান হও, বিগড়াবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে— কথাটা কানেই আনলে না। সেই সময়ে জোরজার করে কোনোমতে শশিমুখীর সঙ্গে ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে কোনো কথাই থাকত না। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! বলি বা কাকে! নিজে যেটি বুঝবে না সে তো মাথা খুঁড়েও বুঝানো যাবে না। এখন বিনয়ের মতো ছেলে তোমার দল ভেঙে গেল, এ কি কম আপশোষের কথা।”

 গোরা কোনো উত্তর করিল না। মহিম কহিলেন, “তা হলে বিনয়কে

৪৮২