পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫০৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

 সুচরিতা সশব্দে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করিয়া মেঝের উপর বসিয়া পড়িল এবং মুখের মধ্যে আঁচলের কাপড় গুঁজিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের শব্দকে প্রাণপণে নিরুদ্ধ করিল। হারানবাবু মুখ কালী করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

 হরিমোহিনী উভয়ের কথোপকথন সমস্ত শুনিয়াছিলেন। আজ তিনি সুচরিতার মুখে যাহা শুনিলেন তাহা তাঁহার আশার অতীত। তাঁহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল, তিনি কহিলেন, ‘হবে না! আমি যে একমনে আমার গোপীবল্লভের পূজা করিয়া আসিলাম, সে কি সমস্তই বৃথা যাইবে?’

 হরিমোহিনী তৎক্ষণাৎ তাঁহার পূজাগৃহে গিয়া মেঝের উপরে সাষ্টাব্দে লুটাইয়া তাঁহার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং আজ হইতে ভোগ আরও বাড়াইয়া দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন। এতদিন তাঁহার পূজা শোকের সান্ত্বনারূপে শান্তভাবে ছিল— আজ তাহা স্বার্থের সাধনরূপ ধরিতেই অত্যন্ত উগ্র, উত্তপ্ত, ক্ষুধাতুর হইয়া উঠিল।



৬৩

সুচরিতার সম্মুখে গোরা যেমন করিয়া কথা কহিয়াছে এমন আর-কাহারও কাছে কহে নাই। এতদিন সে তাহার শ্রোতাদের কাছে নিজের মধ্য হইতে কেবল বাক্যকে, মতকে, উপদেশকে বাহির করিয়া আসিয়াছে— আজ সুচরিতার সম্মুখে সে নিজের মধ্য হইতে নিজেকেই বাহির করিল। এই আত্মপ্রকাশের আনন্দে, শুধু শক্তিতে নহে, একটা রসে তাহার সমস্ত মত ও সংকল্প পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। একটি সৌন্দর্যশ্রী তাহার জীবনকে বেষ্টন করিয়া ধরিল। তাহার তপস্যার উপর যেন সহসা দেবতারা অমৃত বর্ষণ করিলেন।

 এই আনন্দের আবেগেই গোরা কিছুই না ভাবিয়া কয়দিন প্রত্যহই সুচরিতার কাছে আসিয়াছে, কিন্তু আজ হরিমোহিনীর কথা শুনিয়া হঠাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল- অনুরূপ মুগ্ধতায় বিনয়কে সে একদিন যথেষ্ট তিরস্কার ও পরিহাস করিয়াছে। আজ যেন নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেকে

৪৯৯