পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫১০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

সেই অবস্থার মধ্যে দাঁড়াইতে দেখিয়া সে চমকিয়া উঠিল। অস্থানে অসম্‌বৃত নিদ্রিত ব্যক্তি ধাক্কা খাইলে যেমন ধড়্ফড়্ করিয়া উঠিয়া পড়ে, গোরা সেইরূপ নিজের সমস্ত শক্তিতে নিজেকে সচেতন করিয়া তুলিল। গোরা বরাবর এই কথা প্রচার করিয়া আসিয়াছে যে, পৃথিবীতে অনেক প্রবল জাতির একেবারে ধ্বংস হইয়াছে- ভারত কেবলমাত্র সংযমেই, কেবল দৃঢ়ভাবে নিয়ম পালন করিয়াই, এত শতাব্দীর প্রতিকূল সংঘাতেও আজ পর্যন্ত আপনাকে বাঁচাইয়া আসিয়াছে। সেই নিয়মে কুত্রাপি গোরা শৈথিল্য স্বীকার করিতে চায় না। গোরা বলে, ভারতবর্ষের আর-সমস্তই লুটপাট হইয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহার যে প্রাণপুরুষকে সে এই-সমস্ত কঠিন নিয়মসংযমের মধ্যে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে তাহার গায়ে কোনো অত্যাচারী রাজপুরুষের হস্তক্ষেপ করিবার সাধ্যই নাই। যতদিন আমরা পরজাতির অধীন হইয়া আছি ততদিন নিজেদের নিয়মকে দৃঢ় করিয়া মানিতে হইবে। এখন ভালোমন্দ বিচারের সময় নয়। যে ব্যক্তি স্রোতের টানে পড়িয়া মৃত্যুর মুখে ভাসিয়া যাইতেছে সে যাহার দ্বারাই নিজেকে ধরিয়া রাখিতে পারে তাহাকেই আঁকড়াইয়া থাকে, সে জিনিসটা সুন্দর কি কুশ্রী বিচার করে না। গোরা বরাবর এই কথা বলিয়া আসিয়াছে, আজও ইহাই তাহার বলিবার কথা। হরিমোহিনী সেই গোরার যখন আচরণের নিন্দা করিলেন তখন গজরাজকে অঙ্কুশে বিদ্ধ করিল।

 গোরা যখন বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল তখন দ্বারের সম্মুখে রাস্তার উপরে বেঞ্চি পাতিয়া খোলা গায়ে মহিম তামাক খাইতেছিলেন। আজ তাঁহার আপিসের ছুটি। গোরাকে ভিতরে ঢুকিতে দেখিয়া তিনিও তাহার পশ্চাতে গিয়া তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “গোরা, শুনে যাও, একটি কথা আছে।”

 গোরাকে নিজের ঘরে লইয়া গিয়া মহিম কহিলেন, “রাগ কোরো না ভাই, আগে জিজ্ঞাসা করছি- তোমাকেও বিনয়ের ছোঁয়াচ লেগেছে নাকি? ও অঞ্চলে যে বড়ো ঘন ঘন যাওয়া-আসা চলছে!”

 গোরার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। সে কহিল, “ভয় নেই।”

 মহিম কহিলেন, “যেরকম গতিক দেখছি, কিছু তো বলা যায় না। তুমি

৫০০