পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫২৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

করিতে তাঁহার সাহস হইল না। সুচরিতাকে যতই তিনি নিকটে করিয়া দেখিতেছেন ততই তিনি ইহা বুঝিতেছেন যে, তাহাকে তিনি বুঝিতে পারেন নাই।

 হরিমোহিনী অবসর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন এবং পূর্বের চেয়ে সুচরিতার প্রতি বেশি করিয়া সতর্কতা প্রয়োেগ করিলেন। আগে পূজাহ্নিকে তাঁহার যত সময় লাগিত এখন তাহা কমিয়া আসিবার উপক্রম হইল— তিনি সুচরিতাকে আর চোখের আড়াল করিতে চান না।

 সুচরিতা দেখিল গোরার আসা হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেল। সে বুঝিল হরিমোহিনী তাঁহাকে কিছু বলিয়াছেন। সে কহিল, ‘আচ্ছা বেশ, তিনি না’ই আসিলেন, কিন্তু তিনিই আমার গুরু, আমার গুরু।’

 সম্মুখে যে গুরু থাকেন তাহার চেয়ে অপ্রত্যক্ষ গুরুর জোর অনেক বেশি। কেননা, নিজের মন তখন গুরুর বিদ্যমানতার অভাব আপনার ভিতর হইতে পুরাইয়া লয়। গোরা সামনে থাকিলে সুচরিতা যেখানে তর্ক করিত এখন সেখানে গোরার রচনা পড়িয়া তাহার বাক্যগুলিকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করে। না বুঝিতে পারিলে বলে, তিনি থাকিলে নিশ্চয় বুঝাইয়া দিতেন।

 কিন্তু গোরার সেই তেজস্বী মূর্তি দেখিবার এবং তাহার সেই বজ্রগর্ভ মেঘগর্জনের মতো বাক্য শুনিবার ক্ষুধা কিছুতেই কি মিটিতে চায়! এই তাহার নিবৃত্তিহীন আন্তরিক ঔৎসুক্য একেবারে নিরন্তর হইয়া তাহার শরীরকে যেন ক্ষয় করিতে লাগিল। থাকিয়া থাকিয়া সুচরিতা অত্যন্ত ব্যথার সহিত মনে করে, কত লোক অতি অনায়াসেই রাত্রিদিন গোরার দর্শন পাইতেছে কিন্তু গোরার দর্শনের কোনো মূল্য তাহারা জানে না।


 ললিতা আসিয়া সুচরিতার গলা জড়াইয়া ধরিয়া একদিন অপরাহ্ণে কহিল, “ভাই সুচিদিদি!”

 সুচরিতা কহিল, “কী ভাই ললিতা!”

 ললিতা কহিল, “সব ঠিক হয়ে গেছে।”

৫১৩