পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৭১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

আর উহার স্বভাবচরিত্রের কথা বেশি করিয়া বলাই বাহুল্য। ওর স্ত্রী মরার পর ও তো কিছুতেই বিবাহ করিতে চায় নাই; আত্মীয়স্বজন সকলে মিলিয়া অত্যন্ত বল প্রয়োগ করাতে ও কেবল গুরুজনের আদেশ পালন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত করিতে হরিমোহিনীকেই কি কম কষ্ট পাইতে হইয়াছে। ও কি কর্ণপাত করিতে চায়। ওরা যে মস্ত বংশ। সমাজে ওদের যে ভারী মান।

 সুচরিতা এই মান খর্ব করিতে কিছুতেই স্বীকার করিল না। কোনোমতেই না। সে নিজের গৌরব ও স্বার্থের প্রতি দৃক্‌পাতমাত্র করিল না। এমন-কি, হিন্দুসমাজে তাহার স্থান যদি নাও হয় তথাপি সে লেশমাত্র বিচলিত হইবে না, এইরূপ তাহার ভাব দেখা গেল। কৈলাসকে বহু চেষ্টায় বিবাহে রাজি করানোতে সুচরিতার পক্ষে অল্প সম্মানের কারণ হয় নাই, এ কথা সে মূঢ় কিছুতেই উপলব্ধি করিতে পারিল না; উলটিয়া সে ইহাকে অপমানের কারণ বলিয়া গণ্য করিয়া বসিল। আধুনিক কালের এই-সমস্ত বিপরীত ব্যাপারে হরিমোহিনী সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন।

 তখন তিনি মনের আক্রোশে বার বার গোরার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া খোঁচা দিতে লাগিলেন। গোরা যতই নিজেকে হিন্দু বলিয়া বড়াই করুক-না কেন, সমাজের মধ্যে উহার স্থান কী। উহাকে কে মানে। ও যদি লোভে পড়িয়া ব্রাহ্মঘরের কোনো টাকাওয়ালা মেয়েকে বিবাহ করে, তবে সমাজের শাসন হইতে ও পরিত্রাণ লাভ করিবে কিসের জোরে। তখন দশের মুখ বন্ধ করিয়া দিবার জন্য টাকা যে সমস্ত ফুঁকিয়া দিতে হইবে। ইত্যাদি।

 সুচরিতা কহিল, “মাসি, এসব কথা তুমি কেন বলছ! তুমি জাননা এ-সব কথার কোনো মূল নেই।”

 হরিমোহিনী তখন বলিলেন, তাঁহার যে বয়স হইয়াছে সে বয়সে কথা দিয়া তাঁহাকে ভোলানো কাহারও পক্ষে সাধ্য নহে। তিনি চোখ-কান খুলিয়াই আছেন। দেখেন শোনেন বুঝেন সমস্তই, কেবল নিঃশকে অবাক হইয়া রহিয়াছেন। গোরা যে তাহার মাতার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সুচরিতাকে

৫৫৯