পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

এবং বরদাসুন্দরীর মেয়েরা যে অল্পস্বল্প ইংরেজি শিথিয়াছে, ইংরেজ মেমের কাছে প্রশংসা পাইয়াছে, এবং লেপ্টেনাণ্ট্ গবর্নরের স্ত্রীর কাছে ক্ষণকালের জন্য প্রশ্রয় লাভ করিয়াছে, এই গর্বের মধ্যে এক হিসাবে একটা দীনতাও ছিল। কিন্তু এ-সমস্ত বুঝিয়া জানিয়াও বিনয় এই ব্যাপারটাকে গোরার আদর্শ-অনুসারে ঘৃণা করিতে পারে নাই। তাহার এ-সমস্ত বেশ ভালোই লাগিতেছিল। লাবণ্যের মতো মেয়ে— মেয়েটি দিব্য মুন্দর দেখিতে তাহাতে সন্দেহ নাই— বিনয়কে নিজের হাতের লেখা মূরের কবিতা দেখাইয়া যে বেশ একটু অহংকার বোধ করিতেছিল ইহাতে বিনয়েরও অহংকারের তৃপ্তি হইয়াছিল। বরদাসুন্দরীর মধ্যে এ কালের ঠিক রঙটি ধরে নাই, অথচ তিনি অতিরিক্ত উদগ্রভাবে এ-কালীয়তা ফলাইতে ব্যস্ত— বিনয়ের কাছে এই অসামঞ্জস্যের অসংগতিটা ধরা পড়ে নাই যে তাহা নহে, তবুও বরদাসুন্দরীকে বিনয়ের বেশ ভালো লাগিয়াছিল। তাঁহার অহংকার ও অসহিষ্ণুতার সারল্যটুকুতে বিনয়ের প্রতি বোধ হইয়াছিল। মেয়েরা যে তাহাদের হাসির শব্দে ঘর মধুর করিয়া রাখিয়াছে, চা তৈরি করিয়া পরিবেষণ করিতেছে, নিজেদের হাতের শিল্পে ঘরের দেয়াল সাজাইয়াছে, এবং সেই সঙ্গে ইংরেজি কবিতা পড়িয়া উপভোগ করিতেছে, ইহা যতই সামান্য হউক, বিনয় ইহাতেই মুগ্ধ হইয়াছে। বিনয় এমন রস তাহার মানবসঙ্গবিরল জীবনে আর কখনো পায় নাই। এই মেয়েদের বেশভূষা হাসিকথা কাজকর্ম লইয়া কত মধুর ছবিই যে সে মনে মনে আঁকিতে লাগিল তাহার আর সংখ্যা নাই। শুধু বই পড়িয়া এবং মত লইয়া তর্ক করিতে করিতে যে-ছেলে কখন যৌবনে পদার্পণ করিয়াছে জানিতেও পারে নাই, তাহার কাছে পরেশের এই সামান্য বাসাটির অভ্যস্তরে এক নূতন এবং আশ্চর্য জগৎ প্রকাশ পাইল।

 গোরা যে বিনয়ের সঙ্গ ছাড়িয়া রাগ করিয়া চলিয়া গেল সে রাগকে বিনয় অন্যায় মনে করিতে পারিল না। এই দুই বন্ধুর বহুদিনের সম্বন্ধে এতকাল পরে আজ একটা সত্যকার ব্যাঘাত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

 বর্যারাত্রির স্তব্ধ অন্ধকারকে স্পন্দিত করিয়া মাঝে মাঝে মেঘ ডাকিয়া

৮৩