এস্থলে দেখিতে পাওয়া যায়,—মিন্হাজুদ্দীন “কিল্লা বিহার” অধিকারের প্রকৃত বিবরণ জানিতে যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার বিবরণ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য। কিন্তু তিনি যে শ্রেণীর লোকের নিকট হইতে বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাদের পর্য্যবেক্ষণ-শক্তি যে কত দুর্ব্বল, তাহার দুইটি প্রমাণ পাওয়া গেল। তাহারা একটি বৌদ্ধ-বিদ্যালয়কে “কিল্লা” বলিয়া ভ্রম করিতে সমর্থ হইয়াছিল; এবং অনুসন্ধান করিয়াও, তাহারা ঠিক করিয়া উঠিতে পারে নাই যে—মুণ্ডিত-মস্তক বিহারবাসীরা ব্রাহ্মণ নহে, বৌদ্ধ শ্রমণ।
মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার “কিল্লা-বিহার” লুণ্ঠন করিয়া, বহু ধন লাভ করিয়াছিলেন। যে বৌদ্ধ-বিহার আক্রমণকারিগণের নিকট কিল্লা এবং সহর বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল, তাহাতে যে বহু কালের বহু ভক্ত-জনের প্রদত্ত বহু অর্থ সঞ্চিত থাকিবে, ইহাতে আশ্চর্য্যের বিষয় কি? মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার এই লুণ্ঠিত দ্রব্য লইয়া, স্বয়ং দীল্লিতে কুতবদ্দীন আইবকের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন। কুতবুদ্দীন তাঁহাকে বহু সম্মান করিয়াছিলেন। মিন্হাজ লিখিয়াছেন,—মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার দীল্লি হইতে ফিরিয়া আসিয়া, “বিহার জয় করিয়ছিলেন [বিহার ফতে কর্দ]”। এই “বিহার ফতের” কথাটা অতি সাবধানে গ্রহণ করিতে হইবে। “বিহার” বলিতে এখন আমরা যাহা বুঝি, মিন্হাজুদ্দীন সে অর্থে বিহার-শব্দের ব্যবহার করেন নাই। তিনি সুলতান ইয়াল্তিমিসের রাজত্বের বিবরণের শেষে, বিজিত প্রদেশ-সমূহের যে তালিকা দিয়াছেন, তাহাতে “বিহার” এবং “তিরহুত” স্বতন্ত্র উল্লিখিত হইয়াছে। মিন্হাজের “বিহার” দক্ষিণ বিহার বা সাহাবাদ, পাটনা, গয়া, মুঙ্গের, এবং ভাগলপুর জেলা। মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার তিরহুত জয় করা দূরে থাকুক, কোন দিন উহার কোন অংশ আক্রমণও করিয়াছিলেন না। যাঁহার শৈথিল্যে বা দুর্ব্বলতায়, দক্ষিণ-বিহার মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ারের ন্যায় সামান্য জায়গীরদার কর্ত্তৃক পুনঃ পুনঃ আক্রান্ত লুণ্ঠিত এবং অবাধে বিজিত হইতে পারিয়ছিল, সেই “গৌড়েশ্বরের” রাজধানীতে “বিহার ফতের” কাহিনী ঘোর আতঙ্ক উপস্থিত করিয়া, নির্বিরোধে বরেন্দ্র এবং রাঢ়দেশ অধিকারের পথ পরিষ্কার করিয়া থাকিবে।
মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ারের অভ্যুদয়-কালে, যিনি উত্তরাপথের পূর্ব্বাংশের প্রধান নরপাল বা “গৌড়েশ্বর” [মিন্হাজের ভাষায় “হিন্দের রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খালিফাস্থানীয়”] ছিলেন, মিন্হাজুদ্দীন তাঁহাকে “রায় লখ্মনিয়া” এবং তাঁহার “দার-উল্-মুল্ক্” বা রাজধানীকে “সহর নোদিয়া” নামে উল্লেখ করিয়াছেন। মিন্হাজ “রায় পিথোরার” [চৌহান-রাজ পৃথ্বীরাজের] এবং “রায় জয়চাঁদের” [গাহড়বাল-রাজ জয়চ্চন্দ্রের] নামোল্লেখ মাত্র করিয়াছেন, কিন্তু “রায় লখ্মনিয়ার” জীবনচরিত লিপিবদ্ধ করিতেও যত্ন পাইয়াছেন; তাঁহার শাসনরীতির সুখ্যাতি করিয়াছেন; দানশীলতার জন্য তাঁহাকে “সুলতান করিম কুতবদ্দীন হাতেমুজ্জমান” বা সেই যুগের হাতেম কুতবুদ্দীনের সহিত তুলনা করিয়াছেন; এবং উপসংহারে পৌত্তলিক-বিদ্বেষ বিস্মৃত
৭৩