গৌড়রাজমালা।
মিন্হাজ লিখিয়াছেন, “যখন মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার কর্ত্তৃক “বিহার ফতে” হওয়ার সংবাদ রায় লখ্মনিয়ার রাজ্যের “আত্রাফে” পঁহুছিল, তখন এক দল জ্যোতিষী ব্রাহ্মণ-রাজমন্ত্রী রাজার নিকট গিয়া নিবেদন করিল যে, পুরাকালের ব্রাহ্মণগণের পুস্তকে লেখা আছে যে, এই দেশ তুরূষ্কগণের হস্তগত হইবে; এবং এই শাস্ত্রীয় ভবিষ্যৎবাণী সফল হইবার সময়ও আসিয়াছে। সুতরাং সকলেরই এ দেশ হইতে পলায়ন করা উচিত। শাস্ত্রে লেখা ছিল, আজানুলম্বিতবাহু একজন তুরূষ্ক দেশ অধিকার করিবে। মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার আজানুলম্বিতবাহু কি না, দেখিয়া আসিবার জন্য রাজা বিশ্বাসী চর পাঠাইলেন; চরেরা আসিয়া বলিল, মহম্মদ বখ্তিয়ার যথার্থই আজানুলম্বিতবাহু। যখন এই সংবাদ নোদিয়ায় প্রচারিত হইল, তখন “ঐ মৌজার” ব্রাহ্মণগণ এবং সাহাগণ (ব্যবসায়ীগণ) সঙ্কনতে, বঙ্গে, এবং কামরূপে (কামরূদে) চলিয়া গেল। কিন্তু রাজ্য ছাড়িয়া যাওয়া রায় লখ্মনিয়ার পছন্দ “মাফিক” হইল না। সুতরাং মিন্হাজের মতে, যাঁহার খান্দানকে (বংশকে) হিন্দের “রাইয়ান্” বা রাজগণ “বুজুর্গ” মনে করিত, এবং হিন্দের খলিফা বলিয়া স্বীকার করিত, এবং যাঁহার ফরজন্দান্ [বংশধরগণ] “তবকত-ই-নাসিরি” রচনার সময় [১২৬০ খৃষ্টাব্দ] পর্য্যন্ত বঙ্গের শাসনকর্ত্তা ছিল, সেই রায় লখ্মনিয়া একটি বৎসর জনশূন্য নদীয়ায় পড়িয়া রহিলেন!
“দোয়ম সাল (পরের বৎসর) মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার লস্কর প্রস্তুত করিয়া, বিহার হইতে ধাবিত হইলেন; এবং সহসা নদীয়া সহরের নিকট এমন ভাবে উপস্থিত হইলেন যে, ১৮ জনের বেশী সওয়ার (অশ্বারোহী) তাঁহার সঙ্গে ছিল না; এবং “দিগর লস্কর” পশ্চাতে আসিতেছিল। যখন মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার সহরের দরজায় পঁহুছিলেন, কাহাকেও আঘাত করিলেন না, ধীর, স্থির ভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। কেহ মনে করিল না, ইনি মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার; লোকে অনুমান করিল হয়ত একদল সওদাগর বিক্রয় করিবার জন্য ঘোড়া আনিয়াছে। যখন রায় লখ্মনিয়ার বাড়ীর (সরাই) দরজায় পঁহুছিলেন, তখন তলোয়ার খুলিয়া হিন্দুদিগকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
“তখন রায় লখ্মনিয়া আহারে উপবিষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহার নিকট সঠিক খবর পঁহুছিবার পূর্ব্বেই, মহম্মদ-ই-বখ্তিয়ার বাড়ীর ভিতর ঢুকিয়া পড়িয়াছিলেন। তখন বৃদ্ধ রায় নগ্নপদে বাড়ীর পশ্চাদ্ভাগ দিয়া বাহির হইয়া, সঙ্কনাতে ও বঙ্গে প্রস্থান করিলেন। তথায় অল্পকাল পরেই তাঁহার রাজত্বের পরিসমাপ্তি হইয়াছিল।”[১]
লক্ষ্মণসেনের কাপুরুষতায় বাঙ্গালা তুরূষ্কের পদানত হইল, ইদানীং অনেকেই এ কথা বলিয়া থাকেন। কিন্তু মিন্হাজুদ্দীন যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহার প্রতি অক্ষরও যদি সত্য হয়, তাহা হইলে লখ্মনিয়াকে বা লক্ষ্মণসেনকে “কাপুরুষ” না বলিয়া, বীরাগ্রগণ্য বলিয়া পূজা করাই
- ↑ Raverty, pp. 556-558. Text, 150-151.
৭৬