পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/১৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
উপাসক সম্প্রদায়।

অনেক অপ্রকাশিত প্রাচীন-লিপি কলিকাতার যাদুঘরে সংগৃহীত হইয়াছে। তাহার সাহায্যে, পাল-নরপালগণের শাসন-কালের সন-তারিখ-নির্ণয়ের নূতন উদ্যম প্রকাশিত হইতে পারিবে।

 রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়-পরাজয়,—ইহার সকল কথাই ইতিহাসের কথা। তথাপি কেবল এই সকল কথা লইয়াই ইতিহাস সঙ্কলিত হইতে পারে না। বাঙ্গালীর ইতিহাসের প্রধান কথা—বাঙ্গালী জনসাধারণের কথা। জনসাধারণের সকল কথার প্রধান কথা তাহাদিগের ধর্ম্মবিশ্বাসের কথা। ভারতবর্ষের জনসাধারণের পক্ষে তাহাকে একমাত্র কথা বলিলেও, অত্যুক্তি হইবে না। কারণ, ধর্ম্মবিশ্বাসই অধিকাংশ কার্য্যের গতি-নির্দ্দেশ করিয়াছে;—ধর্ম্মের জন্য দেবমূর্ত্তি গঠিত হইয়াছে, দেবমূর্ত্তির জন্য বিচিত্র দেবালয় নির্ম্মিত হইয়াছে, দেবালয়ের প্রচলিত অৰ্চ্চনা-প্রণালীর জন্য উপচার-সংগ্রহের প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছে, দেব-লোকের প্রীতি-সম্পাদনের আশায় জলাশয় খানিত হইয়াছে, চিকিৎসালয় সংস্থাপিত হইয়াছে, পান্থশালা নির্ম্মিত হইয়াছে, বিবিধ বিদ্যালয়ে শাস্ত্রালোচনা প্রচলিত হইয়াছে,—কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-ব্যাপারে উপার্জ্জিত অর্থ, গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজন সাধিত করিয়া, দেব-কার্য্যেই উৎসর্গীকৃত হইয়াছে। ধর্ম্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে যে সকল আচার-ব্যবহার জড়িত হইয়া পড়িয়ছে, তাহার সাহায্যে বাঙ্গালীর জাতিগত পরিচয় লাভ করিবার সম্ভাবনা আছে। কোন্ পুরাকাল হইতে, কিরূপ ঘটনাচক্রে, এ দেশের অধিবাসিবর্গ তাহাদিগের শিক্ষাদীক্ষার এবং আচার-ব্যবহারের প্রভাবে বর্ত্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে, তাহার কথাই প্রধান কথা। অনুসন্ধান-সমিতি তদ্বিষয়ে যে সকল অনুসন্ধান-কার্য্যের সূত্রপাত করিয়াছেন, “গৌড়ীয় উপাসক সম্প্রদায়” নামক গ্রন্থাংশে তাহা আলোচিত হইবে। বঙ্গভূমি যে বহুযুগের বহুবিধ শিক্ষা-দীক্ষার মিলন-ভূমি,—আপাত-প্রতীয়মান মত-পার্থক্যের সমন্বয়ভূমি,—অনন্যসাধারণ স্বাতন্ত্র্য-লিপ্সার কৌতূহলপূর্ণ সাধনভূমি—তাহার নানা পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। এই ভূমিকে স্বতন্ত্র কেন্দ্র করিয়া, ভারতীয় শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতা ভারতবর্ষের বাহিরেও নানা দিগ্দেশে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়ছিল। এই সকল কারণে, বাঙ্গালীর ইতিহাসকে বঙ্গভূমির চতুঃসীমাভুক্ত সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রের ইতিহাস বলিয়া বিচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়ন করিবার উপায় নাই। তাহা একদিকে যেমন বাঙ্গালীর ইতিহাস, অন্যদিকে সেইরূপ মানব-ইতিহাসেরও একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় বলিয়া পরিচিত হইতে পারে। মানব-প্রতিভা, দেশ-কাল-পাত্রের প্রভাবে, কিয়ৎপরিমাণে বিভিন্ন পন্থায় অগ্রসর হইয়া, বিভিন্ন শ্রেণীর পরিণতি লাভের চেষ্টা করিলেও, তাহার অভ্যন্তরে সমগ্র মানব-সমাজের অস্ফুট আকাঙ্ক্ষার পরিচয় প্রদান করে। বাঙ্গালীর ইতিহাসেও তাহার সন্ধানলাভের সম্ভাবনা আছে। সে ইতিহাস সন-তারিখের তালিকায় ভারাক্রান্ত না হইয়াও, অনেক জ্ঞাতব্য তথ্যের সন্ধান প্রদান করিতে পরিবে।

 যাঁহারা এই অধমকে সারথ্যে বরণ করিয়া, অকাতরে বরেন্দ্র-ভ্রমণের অশেষ ক্লেশ সহ্য করিয়াও, অকুণ্ঠিত-চিত্তে অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছেন, তাঁহাদিগের অধ্যয়নানুরাগ,

৸৶৹