পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/২৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
গঙ্গারিডি।

অশোকের সাম্রাজ্য-ভুক্ত ছিল, তাহার জনশ্রুতিমূলক প্রমাণের অভাব নাই। “অশোকাবদান” গ্রন্থে পুণ্ড্রবর্দ্ধন-নগর অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত বলিয়া উল্লিখিত রহিয়াছে। পরিব্রাজক ইউয়ান্ চোয়াং বা হিউয়েন সিয়াং (৬২৯-৬৪৫ খৃষ্টাব্দে) লিখিয়া গিয়াছেন,—তিনি পুণ্ড্রবর্দ্ধন, সমতট, তাম্রলিপ্তি এবং কর্ণসুবর্ণ নামক বাঙ্গালার চারিটি প্রধান নগরের উপকণ্ঠেই অশোক-রাজ-প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ-স্তূপ দেখিতে পাইয়াছিলেন।

 অশোকের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই মৌর্য্য-সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সূত্রপাত হইয়াছিল। খৃষ্ট-পূর্ব্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রারম্ভে, অন্ধ্র, এবং কলিঙ্গ স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিল। “গঙ্গরিডি” হয়ত সেই সময়েই কলিঙ্গের দৃষ্টান্তের অনুসরণ করিয়া থাকিবে। খৃষ্ট-পূর্ব্ব প্রথম শতাব্দীর শেষার্দ্ধে বাঙ্গালীর রণ-পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সুদূর রোম পর্য্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়াছিল। মহাকবি ভার্জিল্ [“জর্জিক্‌স্” কাব্যের তৃতীয় সর্গের সূচনায়] লিখিয়া গিয়াছেন,—তিনি স্বকীর জন্মস্থান মেণ্টুয়া-নগরে ফিরিয়া গিয়া, মর্ম্মর-প্রস্তরের একটি মন্দির নির্ম্মাণ করিবেন; এবং সেই মন্দিরে রোম-সম্রাটের প্রতিমূর্ত্তি স্থাপিত করিয়া, “মন্দিরের দ্বারফলকে সুবর্ণ এবং হস্তিদন্তের দ্বারা ‘গঙ্গরিডিগণে’র যুদ্ধের দৃশ্য এবং সম্রাটের রাজচিহ্ন অঙ্কিত করিবেন।”[১] ভার্জিলের পক্ষে ভারতবর্ষের বিবরণ সংগ্রহ করিবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। ভারতের রাজন্যবর্গ তৎকালে রোমে দূত প্রেরণ করিতেন; এবং ভারতের সহিত রোমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য-সম্বন্ধও বর্ত্তমান ছিল। ভার্জিল্ “জর্জিক্‌সের” প্রথম সর্গে লিখিয়াছেন,—ভারতবর্ষ হইতে রোমে হস্তি-দন্তের আমদানী হইত।

 তৎকালে ‘বারগোসা’ [ভৃগুকচ্ছ বা ভরোচ] এবং ‘গঙ্গরিডির’ প্রধান নগর ‘গঙ্গে’ ভারতের প্রধান বন্দর ছিল; এবং এই দুইটি বন্দর হইতে ভারতের বহির্বাণিজ্য সম্পাদিত হইত। “পিরিপ্লাস্ ইরিথ্রি মেরি” নামক [খৃষ্টাব্দের প্রথম শতাব্দে রচিত] এক খানি গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে,—“গঙ্গে”-বন্দর হইতে প্রবাল, উৎকৃষ্ট মস্‌লিন বস্ত্র, এবং অন্যান্য দ্রব্যের রপ্তানী হইত। খৃষ্টাব্দের দ্বিতীয় শতাব্দে প্রাদুর্ভূত প্রসিদ্ধ ভৌগলিক টলেমি লিখিয়া গিয়াছেন,—“গঙ্গার মোহানা-সমূহের সমীপবর্ত্তী প্রদেশে “গঙ্গরিডিগণ, বাস করে। এই (রাজ্যের) রাজা ‘গঙ্গে’ নগরে বাস করেন।”[২] টলেমি যে বাঙ্গালার ভৌগলিক বিবরণ অবগত ছিলেন, তাহা তাঁহার গ্রন্থোক্ত গঙ্গার মোহানা-সমূহের বিবরণ পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায়। পূর্ব্ববর্ত্তী পাশ্চাত্য লেখকগণ গঙ্গার একটির অধিক মোহানার পরিচয় দিতে পারেন নাই। কিন্তু টলেমি গঙ্গার

  1. “On the doors will I represent in gold and ivory the battle of the Gangaridæ, and the arms of our victorious Quirinius.” Georgics iii, 27, translated by Ransdale and Lee.
  2. McCrindle's Ancient India as described by Ptolemy, (Calcutta, 1883 p. 172.) আধুনিক প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ মেগাস্থিনিস্, টলেমি প্রভৃতির উল্লিখিত জনপদ, নগর এবং নদনদীর দেশীয় নাম এবং স্থিতিস্থান নিরূপণের জন্য যথেষ্ট যত্ন করিয়াছেন। কিন্তু কেহ এ পর্য্যন্ত কোন চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। সুতরাং বাহুল্য ভয়ে তাঁহাদের মতামত উদ্ধৃত হইল না।