পাতা:গৌড়রাজমালা.djvu/৩৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গৌড়রাজমালা।

বিস্তৃত ভূভাগ বশীভূত করিয়া, তিনি গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠত করিয়াছিলেন। গৌড়-মণ্ডল দীর্ঘ কাল উত্তরাপথ-সাম্রাজ্যের অন্তভূর্ত থাকিলেও, ইতিপূর্ব্বেই ভাষায় এবং সাহিত্যে “গৌড়জনে”র স্বাতন্ত্র্য-প্রিয়তা প্রকাশ পাইয়াছিল। প্রাচীন আলঙ্কারিক দণ্ডী [কাব্যাদর্শে] ভাষার মধ্যে “গৌড়ী” নামক স্বতন্ত্র প্রাকৃত-ভাষার, এবং কাব্যরচনায় “গৌড়ী-রীতি” নামক স্বতন্ত্র রচনা-রীতির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। “গৌড়ী”-ভাষা এবং “গৌড়ী”-রীতি গৌড়-রাজ্যের অগ্রদুতরূপে গৃহীত হইতে পারে।

 ঠিক কোন্ খানে যে গৌড়াধিপের সহিত রাজ্যবর্দ্ধনের সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, বাণভট্ট তাহা স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া যান নাই। “হর্ষচরিতের” ষষ্ঠ উচ্ছ্বাসে বর্ণিত হইয়াছে,—রাজ্যবর্দ্ধন স্থানীশ্বর হইতে যুদ্ধযাত্রা করিবার পর, “বহুদিবস অতীত হইলে”, [অতিক্রান্তেষু বহুষু বাসরেষু] হর্ষ সংবাদ পাইলেন, “তাঁহার ভ্রাতা অক্লেশে মালবসৈন্যের পরাজয় সাধন করিতে সমর্থ হইলেও, গৌড়াধিপ তাঁহাকে মিথ্যা লোভ দেখাইয়া, বিশ্বাস উৎপাদন করিয়া, স্বভবনে (লইয়া গিয়া) অস্ত্রহীন অবস্থায় একাকী পাইয়া, গোপনে নিহত করিয়াছেন।”[১] ইউয়ান্ চোয়াংএর গ্রন্থে এই বর্ণনার কিঞ্চিৎ বিকৃত প্রতিধ্বনি পরিরক্ষিত হইয়াছে। ইউয়ান্ চোয়াং লিখিয়াছেন,—প্রভাকরবর্দ্ধনের মৃত্যুর পর (হর্ষবর্দ্ধনের) জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজ্যবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, সদ্ভাবে রাজ্যশাসন করিতেছিলেন। এই সময় ভারতের পূর্ব্বাংশস্থিত কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক অনেক সময় তাঁহার মন্ত্রিগণকে বলিতেন,—‘যদি সীমান্ত প্রদেশের রাজা ধার্ম্মিক হয়, তবে স্বরাজ্যের অকল্যাণ হয়।’ এই কথা শুনিয়া, তাঁহারা রাজা রাজ্যবর্দ্ধনকে সাক্ষাৎ করিতে আহ্বান করিয়াছিলেন, এবং তাঁহাকে নিহত করিয়াছিলেন।”[২]

 বাণভট্ট-প্রদত্ত রাজ্যবর্দ্ধন-নিধনের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয় না। একজন প্রতিযোগী (মালবাধিপতি) যাঁহার ভগিনীপতিকে নিহত করিয়া, ভগিনীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ চরণে কারাগারে নিক্ষেপ করিয়াছিল, সেই রাজ্যবর্দ্ধন যে মুখের কথায় ভুলিয়া, একাকী নিরস্ত্র আর একজন প্রতিযোগীর [গৌড়াধিপের] ভবনে যাইতে সম্মত হইয়াছিলেন তাহা সম্ভব নহে। “হর্ষচরিত” পূর্ব্বাপর আলোচনা করিলে, প্রকৃত ঘটনার কতক আভাস পাওয়া যায়। রাজ্যবর্দ্ধন যখন কান্যকুব্জাভিমুখে যাত্রা করেন, তখন তাঁহার মাতুল-পুত্র ভণ্ডি অশ্বারোহী-সেনার অধিনায়করূপে তাঁহার অনুগমন করিয়াছিলেন।[৩] হর্ষ ভ্রাতৃ-বিয়োগের সংবাদ পাইবামাত্র, “পৃথিবী নির্গৌড়” করিবার জন্য সসৈন্য কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলে, সংবাদ পাইলেন—রাজ্যবর্দ্ধনের বাহুবলে উপার্জ্জিত মালব-রাজ্যের দ্রব্যাদি লইয়া ভণ্ডি আসিতেছেন।[৪] ভণ্ডির আনীত লুণ্ঠিত

  1. জীবানন্দ বিদ্যাসাগর সম্পাদিত “হর্ষচরিতম্” (কলিকাতা, ১৮৯২ খৃষ্টাব্দ), ৪৩৬ পৃঃ।
  2. Beal’s Buddhist Records of the Western World, vol. I. P. 210
  3. হর্ষচরিতম্, ষষ্ঠ উচ্ছ্বাসঃ, ৪২৮ পৃঃ।
  4. হর্ষচরিতম্, সপ্তম উচ্ছ্বাসঃ, ৬০০ পৃঃ।