“পরম-ভাগবত” প্রথম ধ্রুবসেন ২১৬ বলভী সম্বতে (৫৩৬ খৃষ্টাব্দে) সম্পাদিত একখানি তাম্রশাসনের দ্বারা মাতাপিতার পুণ্য বৃদ্ধির এবং স্বকীয় ঐহিক ও পারত্রিক কল্যাণের জন্য ভাগিনেয়ী পরমোপাসিকা দুড্ডা-কর্ত্তৃক বলভী-নগরে প্রতিষ্ঠিত একটি বিহারে স্থাপিত বুদ্ধগণের পূজোপহারের এবং ভিক্ষুসংঘের সেবার জন্য একটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন।[১] শশাঙ্কের প্রতিদ্বন্দ্বী হর্ষ স্বীয় তাম্রশাসনে আপনাকে “পরম মাহেশ্বর” বা শৈব বলিয়া উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, অথচ ইউয়ান্ চোয়াং লিখিয়াছেন—হর্ষ বুদ্ধের এবং বৌদ্ধ-শ্রমণের একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। যে দেশে, যে যুগে শৈব বা বৈষ্ণব-সাধারণের মনে বৌদ্ধধর্ম্ম-বিদ্বেষ স্থানলাভ করিতে পারিত না, সেই দেশের, সেই যুগের, শশাঙ্কের ন্যায় একজন গৃহস্থ শৈবের পক্ষে, বৌদ্ধধর্ম্ম-লোপের কল্পনা অসম্ভব।
দ্বিতীয় কারণ, ইউয়ান্ চোয়াং স্বয়ং লিখিয়া গিয়াছেন,—তৎকালে পুণ্ড্রবর্দ্ধন, কর্ণসুবর্ণ, সমতট, এবং তাম্রলিপ্তি, বাঙ্গালার এই চারিটি প্রধান নগরে, বহুসংখ্যক বৌদ্ধশ্রমণ এবং অনেক বৌদ্ধমঠ স্তূপ, এবং বোধিসত্ত্ব-মন্দির বর্ত্তমান ছিল। শশাঙ্ক এই সকল নগরের বৌদ্ধ-কীর্ত্তিকলাপের ধ্বংস-সাধনের চেষ্টা করিয়াছিলেন বলিয়া ইউয়ান্ চোয়াং তাঁহার গ্রন্থে কোনও আভাস প্রদান করেন নাই। শ্রমণগণের নির্য্যাতন এবং বৌদ্ধ-মন্দিরাদির ধ্বংস-সাধন করিয়া, বৌদ্ধধর্ম্মের মূলোৎপাটনই যদি শশাঙ্কের উদ্দেশ্য হইত, তবে তিনি বরেন্দ্র, রাঢ় এবং বঙ্গেই তাহার সূচনা করিতেন। বাঙ্গালার বৌদ্ধগণকে নির্ব্বিরোধে স্বধর্ম্মানুষ্ঠান করিতে দিয়া, তিনি যখন মগধে ও মিথিলায় [কুশীনগর প্রদেশে] বৌদ্ধ-দলনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, তখন বুঝিতে হইবে—ইহার মূলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল না,—স্বতন্ত্র কারণ বিদ্যমান ছিল। বুদ্ধগয়া এবং কুশীনগর বৌদ্ধগণের প্রধান তীর্থস্থান। এই দুই স্থানের বৌদ্ধ-শ্রমণগণ বৌদ্ধ-সম্প্রদায় মধ্যে নিশ্চয়ই অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। শশাঙ্ক এবং হর্ষবর্দ্ধনের বিরোধ উপস্থিত হইলে, হর্ষ যখন মিথিলা এবং মগধ জয়ের চেষ্টা করিতেছিলেন, তখন হয়ত বুদ্ধগয়া এবং কুশীনগরের শ্রমণগণ হর্ষবর্দ্ধনের অনুকূলে কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছিলেন, এবং এই অপরাধের দণ্ড দিবার জন্য শশাঙ্ক তাঁহাদের নির্য্যাতনে এবং বোধি-বৃক্ষাদি ধ্বংস করিয়া, ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র বুদ্ধগয়ার মাহাত্ম্য-নাশে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। শশাঙ্ক জীবিত থাকিতে, হৰ্ষবর্দ্ধন যে মগধে স্বীয় প্রভাব-বিস্তারে সমর্থ হয়েন নাই, ইউয়ান্ চোয়াং প্রদত্ত শশাঙ্কের মৃত্যুবিবরণই তাহার প্রধান প্রমাণ।
গৌড়াধিপ শশাঙ্কের পরলোক গমনের পর, সহজেই তদীয় সাম্রাজ্য হর্ষবর্দ্ধনের পদানত হইয়াছিল। ইউয়ান্ চোয়াং বাঙ্গালার বিভিন্ন প্রদেশের রাজধানী পুণ্ড্রবর্দ্ধন, সমতট, তাম্রলিপ্তি এবং কর্ণসুবর্ণের বিবরণে কোনও রাজার উল্লেখ করেন নাই। পুণ্ড্রবর্দ্ধন, সমতট এবং তাম্রলিপ্তির প্রাচীন রাজবংশ সম্ভবতঃ শশাঙ্ক কর্ত্তৃক উন্মূলিত হইয়াছিল এবং কর্ণসুবর্ণে শশাঙ্কের উত্তরাধিকারী হৰ্ষবর্দ্ধন কর্ত্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইয়াছিলেন। ৬৪৮ খৃষ্টাব্দে হৰ্ষবর্দ্ধনের মৃত্যুর পর, সপ্তম শতাব্দীর
- ↑ Indian Antiquary, vol. IV. (1875), pp. 104-107.
১৩