গৌড়রাজমালা।
সাম্রাজ্য-সম্ভোগ ঘটিয়া উঠে নাই। গৌড়-বঙ্গ-বিজয়ের অনতিকাল পরেই, [৭৩৬ খৃষ্টাব্দের পরে] কাশ্মীরের অধিপতি ললিতাদিত্য-মুক্তাপীড় আসিয়া, তাঁহাকে কান্যকুব্জের সিংহাসন হইতে অপসারিত করিয়াছিলেন।[১] “রাজতরঙ্গিণী” এই ঘটনার চারিশত বৎসরের কিঞ্চিদধিক কাল পরে [১১৫০ খৃষ্টাব্দে] সম্পূর্ণ হইয়াছিল,[২] এবং কহ্লণ সম্ভবতঃ জনশ্রুতি অবলম্বনেই ললিতদিত্যের কান্যকুব্জ-বিজয়-কাহিনী সঙ্কলন করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি যে ভাবে এই কাহিনীর বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা পর্য্যালোচনা করিলে, ইহাকে ঐতিহাসিক ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দিতে সাহস হয় না। কহ্লণ লিখিয়াছেন,—ললিতাদিত্য-মুক্তাপীড় “কবি বাক্পতিরাজ-শ্রীভবভূতি-আদি-সেবিত” যশোবর্ম্মাকে বশীভূত করিয়া, কলিঙ্গ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তখন গৌড়মণ্ডল হইতে অসংখ্য হস্তী আসিয়া তাঁহার (সেনার) সহিত মিলিত হইল।”
গৌড়ের মহাসামন্ত যেন কান্যকুব্জ-বিজয়ী ললিতাদিত্যকে করস্বরূপ এই সকল হস্তী প্রদান করিলেন। কহ্লণ-বর্ণিত ললিতাদিত্যের দক্ষিণাপথ-বিজয়-কাহিনী কিয়ৎ পরিমাণে কল্পনা-প্রসূত বলিয়া মনে হইতে পারে। যশোবর্ম্মার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার গৌড়ীয় মহাসামন্তকেও সম্ভবতঃ ললিতাদিত্যের পদানত হইতে হইয়াছিল; এবং নবীন সম্রাটের মনস্তুষ্টির জন্য, হস্তী উপঢৌকন দিতে হইয়াছিল। তাহার পরে বোধ হয়, ললিতাদিত্যের আজ্ঞানুসারে গৌড়পতিকে কাশ্মীরে যাইতে হইয়াছিল। ললিতাদিত্য স্বনির্ম্মিত পরিহাস-পুর [বর্ত্তমান পরসপুরীড়ার] নামক নগরে প্রতিষ্ঠিত “পরিহাস-কেশব” নামক নারায়ণ-মূর্ত্তিকে মধ্যস্থ-[জামিন] রাখিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন—তিনি গৌড়পতির গাত্রে হস্তক্ষেপ করিবেন না। তথাপি কোন কারণ বশতঃ ঘাতুক নিযুক্ত করিয়া, পরিহাসপুরের অনতিদূরস্থিত ত্রিগ্রাম নামক স্থানে গৌড়রাজের বধ সাধন করাইয়াছিলেন। এই সংবাদ যখন গৌড়ে পঁহুছিল, তখন গৌড়পতির একদল ভৃত্য এই নৃশংসতার প্রতিশোধ লইবার জন্য, শারদাতীর্থ-দর্শনে যাইবার ভাণ করিয়া, কাশ্মীর প্রবেশ করিলেন; এবং পরিহাস-কেশবের মন্দির অবরোধ করিলেন। পূজকগণ তখন মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। গৌড়-যোদ্ধৃগণ প্রবল পরাক্রমের সহিত মন্দির আক্রমণ করিয়া, রামস্বামী নামক রজত-নির্ম্মিত আর একখানি নারায়ণ-মূর্ত্তি দেখিতে পাইলেন, এবং পরিহাস-কেশব-ভ্রমে তাহা ভাঙ্গিয়া ধূলিসাৎ করিলেন। ইতিমধ্যে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর হইতে সৈন্য আসিয়া, তাঁহাদিগকে বাধা দিতে প্রবৃত্ত হইল। গৌড়ীয়গণ যখন রামস্বামীর মূর্ত্তি ভাঙ্গিতে বিব্রত, তখন কাশ্মীর-সেনা তাঁহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়া, পশ্চাৎদিক হইতে তাঁহাদিগের শিরশ্ছেদ করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেদিকে দৃক্পাত না করিয়া, গৌড়ীয়গণ মূর্ত্তি-ধ্বংসে নিবিষ্ট রহিলেন; এবং একে একে সকলেই শত্রুর তরবারির আঘাতে নিহত হইলেন। কহ্লণ লিখিয়াছেন,—“দীর্ঘকালে লঙ্ঘনীয় গৌড়
- ↑ এম্, এ, ষ্টিন অনূদিত “রাজতরঙ্গিণীর” ভূমিকা ও টিপ্পনী দ্রষ্টব্য।
- ↑ “अशिश्रियं स्तं निःशेषा दण्डिनो गौड़मण्डलात्॥ (৪।১৪৮)॥”
১৬